ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বোরো হাওরে স্বপ্ন ভাসে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২০
বোরো হাওরে স্বপ্ন ভাসে

বিষয়টা হালে টক অব দ্য কান্ট্রি। কৃষি খাতে এখন সব চেয়ে বড় সমস্যা বোরো মৌসুমে ধান কাটা নিয়ে। বোরো ধান কাটতে বর্তমানে পর্যাপ্ত কৃষিশ্রমিক বা দাওয়াল নেই। সেই তীব্র সংকটই চলছে হাওরে।

ধুঁকছে হাওর। মাঠে মাঠে দুলছে সোনালি ফসল।

একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরেকদিকে করোনা দুর্যোগ। পাকা ধান লুটিয়ে পড়ছে জমিনে। কৃষকের হৃদকম্পনে বোরো হাওরে স্বপ্ন ভাসছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব আজ গৃহবন্দি। কতদিন নাগাদ বের হওয়া যাবে ঠিক নেই। অর্থমন্ত্রীর মুখে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘুরলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বলছে, বিশ্ব মন্দাযুগে প্রবেশ করেছে। একদিনের হরতালের ক্ষতি যেখানে বিরাট প্রচার, সেখানে দেড় মাস ধরে চলা ও সামনের দিনগুলোতে ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা মুশকিল।

জাতিসংঘসহ অনেকেই দিয়েছে দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত। অনিবার্যভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাড়ির আঙ্গিনা ও টবসহ দেশের এক ইঞ্চি খালি জায়গাও আবাদের বাইরে না রেখে উৎপাদন বাড়ানোর জোরালো তাগিদ দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, বোরো ধান ঘরে তোলা না গেলে বড় বিপদ আছে। এতো বোঝাবুঝির মাঝেও প্রায় সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমির পাকা ধান ক্ষেতেই ঝরে পড়ার বিপদ হাওরবাসীর সামনে।

হাওর দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। বিশেষ করে বোরো ওঠার প্রাক্কালে পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যা, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখীর ঝড়-তুফান, অতিবৃষ্টিতে হাওররক্ষা বাঁধ ভাঙা অন্যতম। এর একটিই পারে নিমিষে কৃষকের বোনা স্বপ্ন ভাসিয়ে নিতে। শুধু আগাম বন্যায় প্রায় প্রতিবছরই ক্ষতি হয় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টরের মতো জমির ফসল। ইতোমধ্যেই নদীসমূহের পানি বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে তাড়াতাড়ি ধান কাটার তাগিদ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ সময় দরকার একসাথে বেশি কৃষিশ্রমিক। কিন্তু নতুন মাত্রা নিয়ে যুক্ত হওয়া প্রাণঘাতী করোনাদুর্যোগে কৃষিশ্রমিকের তীব্র সংকট কৃষকের সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

কৃষিশ্রমিক নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর আশ্বাস ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে কৃষক। ধানকাটা শুরু হয়েছে চৈত্রের তৃতীয় সপ্তাহেই। এখনও পর্যন্ত কৃষিশ্রমিকের সংকট কাটেনি। এছাড়া 'দাওয়াল' ছাড়াও গোমস্তা বা মুনি, রোজিন্দায় রাখা ও ফসল তোলার প্রাক্কালে রাখা কামলা এমনকি কৃষক নিজেও সামাজিক দূরত্ব নিয়ে করোনায় গৃহবন্দি। অথচ এখনই ধান কাটার উপযুক্ত সময়।

হাওরাঞ্চল ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোরো আবাদ হলেও মৌসুমের প্রথমেই ধান পাকে হাওরে। এ সময় বেকার বসে থাকা কৃষিশ্রমিকরা ওই এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটতে হাওরে আসে। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় ও লকডাউন থাকায় কিছু কিছু জায়গায় পৌঁছলেও অধিকাংশ জায়গায় এখনও এসে পৌঁছায়নি। মজুরিও চড়া। দেড়-দুই মণ ধানের মূল্য চলে যাচ্ছে জনে।

স্বাস্থ্যবিধির বাঁধনে স্থানীয় কৃষিশ্রমিকরাও বাঁধা। কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা জানায়, করোনা ভীতিতে শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ হাওরের ক্ষেতের পাকাধান ক্ষেতেই মজছে। চৌদ্দ আনা পাকতেই অর্থাৎ দুআনা কাষ্টি থাকতেই ধান কেটে ফেলতে হয়। নতুবা ক্ষেতেই বিনষ্ট হয়। এ দুশ্চিন্তায় কৃষকের চোখে ঘুম নেই। করোনার সাথে বোরো মিশে স্নায়ু চাপে ভুগছে প্রশাসনও।

কৃষি মন্ত্রণালয় এবার ধান কাটার যন্ত্র ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার বরাদ্দ দিয়েছে। পুরনো মিলিয়ে সচল রয়েছে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১ হাজার ৫৬টি রিপার। আর অচল হয়ে পড়ে রয়েছে ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার। এগুলো মাঠে ফেরা দুরাশা। কেননা, কৃষি যন্ত্রপাতি ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠপর্যায়ের কর্মচারিরাও লকডাউন আটক ও করোনা আতঙ্কে। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রই যদি ভরসা হয়, তাহলে সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর ধানিজমির বিপরীতে যন্ত্রের সংখ্যা নেহায়েত কম।

হাওরের শ্রম শহরে চলে যাওয়ায় হাওরের কৃষিশ্রমিক সংকট চলছে দুযুগ ধরে। সংকট মোচনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো দীর্ঘকালের ব্যবধানেও যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়নি। হাওরের প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, 'যার আছে সাতপুত তের নাতি, সে যেন করে গেরস্তি'- ওইদিনও নেই।

হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাতটি জেলার বোরো ধান স্থানীয় প্রায় দুকোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যত্র চালান হয়। খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ খাদ্য যোগানদাতা হাওরের কৃষক। ওই কৃষকই জানেন না কীভাবে ফসল ঘরে তুলবেন।

মৌসুমের পয়লা ধান কাটা হয় কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঢাকীর হাওরে। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ধান কাটা কর্মসূচি শুরু করেছেন কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের এমপি ও বাংলাদশ কৃষক লীগের উপদেষ্টা প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। তার এ উদ্যোগ বেশ প্রসংশিত হয়েছে। আপৎকালীন মুহূর্তে এ উদযোগটি স্মল নয়, গ্রেটফুল। ভাবাবেগ ও আইওয়াশ ছেড়ে অনুকরণীয় হয়ে প্রয়াসটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে বিশাল হাওর শুধু নয়, সারাবাংলায় ছড়িয়ে পড়লে হতে পারতো 'উইন উইন' সমাধান। অর্থাৎ দুজনার জয়।

কাজটি শ্রমঘন। অভ্যস্তও হতে হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, যন্ত্র ও কৃষিশ্রমিক ছাড়া ফসল ঘরে তোলা ও বাজারজাতকরণ অসম্ভব। যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে মাঠের ধান মাঠেই পড়ে থাকবে। কৃষকরা বলছেন, হাওরের কর্দমাক্ত নরম জমিতে যন্ত্র তেমন খাটে না। এছাড়া খড়ও ঠিকমতন জোটে না বলে গো-খাদ্যেও টান পড়ে। তাই ধান কাটা, পরিবহন, মাড়াই, সিদ্ধ, শুকানো, উড়ানো, ঘরে তোলা ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত কৃষিশ্রমিকের সরব উপস্থিতি ছাড়া অসম্ভবপ্রায়।

এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে কর্মরত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ধান কাটার স্থানীয় কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে তাদের ধান কাটায় উদ্বুদ্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিটি উপজেলায় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষিশ্রমিক সংগ্রহের আহ্বান জানানো হলেও মাঠে ধান কাটতে কৃষকের দেখা মিলছে না। অনুপ্রেরণা, তিন ফুটের সামাজিক দূরত্ব, যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সুরক্ষা, গৃহস্থের মজুরির পাশাপাশি পর্যাপ্ত ত্রাণ ও কৃষিশ্রমিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করলে শ্রমিক সংগ্রহ সম্ভব হতে পারে। এর জন্যই তথ্য ও সহযোগিতা দিয়ে মাঠে থাকতে হবে জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতাকর্মীদেরও। কাজটি করতে গিয়ে করোনা ভাইরাসটি না আবার সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সেখানে মেডিক্যাল টিমের বিকল্প নেই। শুধু আহ্বানেই দায় না সেরে সময় থাকতে দেশের এ ক্রান্তিকালে যুদ্ধকালীন বিচারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে থাকতে হবে দেখভালের উত্তম ব্যবস্থা। তবেই উৎপাদন ব্যবস্থার ধস রোখা যেতে পারে। মানুষ কিন্তু খেয়ে মরতে চায়।

খাদ্য মজুদে সরকার সংগ্রহমূল্য গতবারের সমান রেখে কৃষকের কাছ থেকে ১৯ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে। ২৬ টাকা কেজি দরে ৭ লাখ টন ধান ও ৩৬ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ টন চাল। অর্থাৎ ২ কোটি ৪ লাখ টন ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার কিনবে ১৯ লাখ টন, যা উৎপাদনের ৬-৭ ভাগ মাত্র। বাকি ধান কৃষকের কাছ থেকে অর্ধেক মূল্যে কেনার সুযোগ পাবে ফড়িয়া মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। ধানের চেয়ে চাল প্রায় দ্বিগুণ বেশি কেনা হচ্ছে। ধান দেয় কৃষক আর চাল দেয় চাতালের মালিক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ বছর ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন বোরো থেকে চাল উৎপাদিত হবে। আর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চালের জোগান দেয় বোরো ধান।

কৃষক বাঁচতে চায়। তারা বলছেন, বোরো ধানে উৎপাদন খরচ হয় কেজিতে ২৫ টাকা। সরকার কিনে ২৬ টাকা। আর আমরা ফড়িয়াদের কাছে ধান বেচি মাত্র ১৩ টাকা কেজি এবং চাল কিনে খায় ৫০ টাকা কেজি। এভাবেই বাঁইচ্চা থাহা! কথা ক'টির ভেতর গোটা কৃষি অর্থনীতি। এর শোলক সন্ধানে কৃষিবান্ধব সরকার ফলে পরিচয় দিক। কৃষক স্কেপগোট বা বলিরপাঁঠা হয়ে আর থাকতে চায় না।

কৃষি, পোশাক ও শ্রম রপ্তানি জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার ধরে রাখলেও কৃষিই স্থায়ী খাত। কৃষকরাই হচ্ছেন খাদ্যনিরাপত্তার পাহারাদার। সেই পাহাদারই অরক্ষিত থাকছে।

করোনা দুর্যোগের মুখে খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে এবারের ধান ও চাল সংগ্রহ-লক্ষ্যমাত্রা অন্তত ২৫ লাখ টন করার দাবি রাখে। ধান বেশি কেনা হলে কৃষকের লাভ। সেটি যেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ কর্তৃক জমির সঠিক পরিমাণ রেকর্ডের ভিত্তিতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা-সংগ্রহ করা হয়। কয়েক বছর ধরে বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকের জন্য এবারও একই অবস্থা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট বিপর্যয় ঢেকে আনবে। ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা বিশেষ করে কৃষিবীমা চালুসহ উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র কৃষক, প্রান্তিক কৃষকদের নগদ সহায়তা ও কৃষি ঋণ তথা সংশ্লিষ্ট সহায়তা দেওয়া খুবই জরুরি। কৃষক চায় স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুরক্ষা। তবেই উৎপাদনে প্রাণ পাবে কৃষক। হাওরও হাসবে আবার।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।