ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের করোনাকালীন উপলব্ধি 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, জুন ২, ২০২০
একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের করোনাকালীন উপলব্ধি 

সরকারিভাবে ২৯ মার্চ হতে অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে ২৬ মার্চ হতে অফিস বন্ধ রয়েছে। কিন্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি অফিস থেকে ছুটিতে ছিলাম ১৯ মার্চ হতে। ১৬ মার্চ হঠাৎ করে আমার বাসার কাজের মেয়েটির জ্বর, গলা ব্যথা ও কাশি শুরু হয়। মেয়ে দুটির দেখাশোনার সুবিধার্থে আমি সেদিন ছুটি নিয়ে বাসায় থেকে যাই। সতর্কতার অংশ হিসেবে একজন পরিচিত ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেদিন থেকেই তাকে অ্যাজিথ্রমাইসিন এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে শুরু করি। গলা ব্যথার জন্য রাতে শোয়ার সময় Nysytat Drop মুখে নিয়ে ঘুমাতে বলি।

পরের দিন ১৭ মার্চ অফিসে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছোট মেয়েকে নিয়ে যোগ দিই। ১৮ মার্চ অফিসে গিয়ে বিকালের দিকে নিজের গলায় চুলকানি ও খুশখুশে কাশি অনুভব করি।

পরে রাতে হালকা জ্বর, কাশি ও গলা ব্যথা শুরু হয়। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ১৯ তারিখ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকি এবং সাবধানতার অংশ হিসেবে সকালেই আমিও অ্যাজিথ্রমাইসিন খেতে শুরু করি ও রাতে Nysytat Drop মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে ঘুমানোর আগে যখন জানতে পারলাম আমাদের সাথে থাকা আমার স্ত্রীর ছোট বোনেরও গলা ব্যথা, কাশি ও হালকা জ্বর শুরু হয়েছে, তখন রাতেই তাকেও অ্যাজিথ্রমাইসিন শুরু করিয়ে দিই এবং শোয়ার সময় Nysytat Drop মুখে দিয়ে ঘুমাতে বলি।  

২১ তারিখ রাতে আমার ৭ বছরের মেয়ে আমার কোলের মধ্যে শুয়ে থাকা অবস্থায় তার শরীরে গরম ভাব অনুভব করি এবং পরে তারও গলা ব্যাথা, কাশি ও জ্বর শুরু হয়। রাতেই তাকেও অ্যাজিথ্রমাইসিন সিরাপ শুরু করিয়ে দিই এবং শোয়ার সময় Nysytat Drop মুখে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখি।  

পরের দিন জ্বরের সাথে সাথে তার পাতলা পায়খানা শুরু হয়। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনই সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকি। ততদিনে বাসার কাজের মেয়েটির অবস্থা ভালো হতে শুরু করেছে। কাশি কিছুটা থাকলেও তখন সে অনেকটাই সুস্থ। কিন্ত আমাদের বাকি তিনজনের কাশি ও হালকা জ্বর থাকলেও হয়ত Nysytat Drop ব্যবহারের জন্য কারও তেমন গলা ব্যাথা ছিল না।  

আমার কাশি আস্তে আস্তে কমতে থাকলেও ৪/৫ দিনের দিন শুরু হয় হালকা শ্বাসকষ্ট। রাতে অ্যাজমাসল ইনহেলার ব্যবহার করলে শ্বাসকষ্ট কমে যেত কিন্তু মাঝে মাঝেই হালকা শ্বাসকষ্ট হতো। ৭/৮ দিনের দিন আমি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠি। মজার ব্যাপার হলো, ঝামেলা এড়াতে আমি বাসার কাউকেই কোন হাসপাতালে পাঠাতে সাহস পাইনি। কিন্ত আল্লাহর রহমতে অল্পদিনের মধ্যেই বাসার সবাই সুস্থ হয়ে ওঠে। আলহামদুলিল্লাহ!!!

ঘটনা শুরুর ১৭/১৮ দিন পর ৫ এপ্রিল অফিসের কাজে প্রথম বাসা থেকে বের হই। তারপর হতে সপ্তাহে দুই/তিন দিন নিয়মিত অফিস করে চলেছি। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিভাগে আমি কাজ করি সেই বিভাগের সাথে সরকারের যাবতীয় বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সংক্রান্ত কাজের সম্পর্ক রয়েছে। বিভাগটি দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক জনাব কাজী ছাইদুর রহমান স্যারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে আসছে।   

বিভাগটির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাংক, জাতিসংঘ ও তাদের অঙ্গ সংগঠন, জাইকা এবং  এডিবিসহ সকল দাতা সংস্থা হতে সরকারের সমস্ত বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যসমূহ গ্রহণ এবং পরিশোধ সংক্রান্ত নির্দেশনা, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় হতে আগত বিভিন্ন বৈদেশিক ঋণের প্রিন্সিপাল ও সুদের কিস্তি নির্ধারিত তারিখে পরিশোধ, বিভিন্ন সরকারি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটা সংক্রান্ত বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ, বিভিন্ন দূতাবাসের খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা, কুটনীতিকদের বেতন-ভাতা, ভিভিআইপিদের বিদেশ সফর সংক্রান্ত বৈদেশিক মুদ্রা ও যে কোন বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/রেজিষ্ট্রেশন ফি সংক্রান্ত বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ, জাতিসংঘ শান্তি মিশন হতে প্রেরিত অর্থ জমাকরণ এবং বিভিন্ন দুতাবাসের আয় সরকারি হিসাবে জমাকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।  

পাশাপাশি দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের FC Clearing সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ, ব্যাংকসমূহের চাহিদা মাফিক বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয়, ডলারের মার্কেট প্রাইস ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বিনিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত নির্দেশনা ও তাদের হিসাবায়ন, রিজার্ভের রিস্ক ও মার্কেট এনালাইসিস, আকু সদস্য দেশসমূহের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসাবায়ন ও বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইমপোর্ট পেমেন্ট সেটেলমেন্ট, Export Development Fund (EDF) ব্যবস্থাপনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ করে থাকে।  

উল্লিখিত বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধসমূহের মধ্যে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, সফর, বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম ছাড়া এই Pandemic period-এ প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোন একটি বৈদেশিক ঋণের কিস্তি সময়মত পরিশোধ না হলে কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কোন কমার্শিয়াল ব্যাংকি এলসির পেমেন্ট দিতে না পারলে দেশের সুনাম খোয়ানোর সাথে সাথে বড় অংকের জরিমানাও গুনতে হবে। আবার এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে কীট/পিপিই/ভেন্টিলেটর ইত্যাদি আমদানির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কোন পেমেন্ট দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।  

কোন দাতা সংস্থার নিকট হতে কোন সহায়তা আসতে পারে যা তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট হিসাবে জমা করতে হয়। ইতিমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির আর্থিক সহায়তার দুটি প্যাকেজ সরকারি হিসাবে জমা করা হয়েছে। সরকার এডিবির আর্থিক সহায়তার এই প্যাকেজ হতে ইতোমধ্যে ৫০ লক্ষ পরিবারকে ২,৫০০/- হারে সহায়তা প্রদান করেছে। এই জরুরি সময়েও বিভাগটি হতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রক্ষিত প্রকল্পের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে যা এই মহামারিতে সরাসরি ব্যাংকগুলোকে লিকুইড সাপোর্টও দিয়েছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই জরুরি কাজ। কারণ এই দূর্যোগ মুহূর্তে ব্যাংক হতে তার ক্লায়েন্টরা শুধু টাকা তুলছে; জমার পরিমাণ খুবই নগণ্য।

আমার চাকরি জীবনে কাজ করতে গিয়ে দেশের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় কখনও কাজ করেছি বলে মনে হয় না। করোনা আমাকে বুঝিয়েছে, দেশের অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে খুব আগ্রহভরে দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক করোনা মহামারিতে অর্থনীতির চাকা ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক মাননীয় গভর্নর মহোদয়ের নেতৃত্বে কিভাবে নিরলস কাজ করে চলেছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংক চলমান আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যত যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; ব্যাংকে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য এখন পর্যন্ত ৪১ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন ঘোষণা; CRR ৫.৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৪.০ শতাংশ নির্ধারণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাড়তি ১৯.৫০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সরবরাহ; রেপোর সুদহার ৬ ভাগ হতে ৭৫ বেসিস কমিয়ে ৫.২৫ ভাগে নির্ধারণ ও ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মোকাবেলার সুবিধার্থে ৩৬০ দিন মেয়াদের বিশেষ রেপো সুবিধা ঘোষণা এবং ব্যাংকগুলোর ঘোষিত নগদ ডিভিডেন্ড আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ বন্ধ রেখেছে।

এছাড়া ৪% রেয়াতি সুদ হারে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সুদ/ক্ষতি বাবদ ৫% সুদ পুনর্ভরণ প্রদান করবে। এই ফান্ডের বর্তমান আকার ১৪,৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব আয় হতে এই খাতে ভর্তুকি দিবে ৯০৫.২৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল হতে নিম্ন আয়ের পেশাজীবি, কৃষক ও প্রান্তিক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য স্বল্প সুদে ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কীম ঘোষণা করেছে; EDF ও Green Transformation Fund বৃদ্ধি করে যথাক্রমে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ও ৪০০ মিলিয়ন ইউরো এবং EDF এর সুদ হার কমিয়ে ২% নির্ধারণসহ EDF লোনের লিমিট বৃদ্ধি ও Usance back to back LC’র বিপরীতে আমদানিতে EDF হতে ১৮০দিন মেয়াদি ঋণ সুবিধা প্রদান করেছে।  

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর ঋণদানের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য ADR ৮৫ শতাংশ হতে বাড়িয়ে ৮৭ শতাংশ এবং ইসলামিক ব্যাংকিং এর জন্য IDR ৯০ শতাংশ হতে বাড়িয়ে ৯২ শতাংশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনে হয়ত আরও অনেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এছাড়া, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নির্ধারণসহ নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক তার ওপর অর্পিত গুরু দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রয়েছে।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি জরুরি জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলে জেনে এসেছি। গত প্রায় ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করছি। দৈনন্দিন নিয়মে অফিস করায় এর অপরিহার্যতা জানা থাকলেও এতোটা তীব্রভাবে বোঝার অবকাশ পাইনি। দেশের এই সংকটকালে কাজ করতে গিয়ে নতুন করে বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়ে গেল। চৌদ্দ বছরে যা উপলব্ধিতে আসেনি, দুই মাসের করোনা আমাকে সেই উপলব্ধি দিয়েছে। বর্তমান গভর্নর জনাব ফজলে কবির স্যার সম্ভাব্য আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংককে যেভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা দেখে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে গর্ববোধ হচ্ছে। প্রত্যাশা করি করোনা মহামারি থেকে দ্রুতই আমরা সুস্থ জীবনে ফিরে আসব। আসুন ততদিন সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি মেনে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, এফআরটিএমডি, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, ঢাকা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।