ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রমা চৌধুরীর সাক্ষাৎ ও কিছু কথা  

আলাউদ্দিন খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২০
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রমা চৌধুরীর সাক্ষাৎ ও কিছু কথা   প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রমা চৌধুরী। ফাইল ছবি

দুই হাজার তেরো সালের সাতাশ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গণভবনে দেখা করতে যান দিদি রমা চৌধুরী। তখনো একাত্তরের জননী হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিতি পাননি তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের এই প্রক্রিয়ার সবটুকু জুড়ে আমি ছিলাম দিদির সার্বক্ষণিক সঙ্গী।

দিদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে যেতে চান নি। তিনি ফোনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলকে বলেছিলেন-আমাকে দেখতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে আসুক, আমি যাবো না। দুইদিন ধরে দিদি নারাজ ছিলেন যেতে। এসব কথা তখন মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই জেনেছেন। তবুও শেষ পর্যন্ত দিদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গণভবনে গিয়েছিলেন। দিদির শর্ত ছিলো-প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যেনো কিছু না দেন। দিলেও দিদি ফিরিয়ে দেবেন। দিদি কেনো, কোন কারণে, কোন অভিমান থেকে এবং কতটা মনের জোরে নিজের চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেও এমন কথা বললেন? 

দিদি একজন সন্তানহারা, মুক্তিযুদ্ধের কারণে সর্বস্বহারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী। সেই নারী, সেই মানুষটাকে আসলে কয়জন বুঝতে পেরেছিলো? সেসব প্রশ্ন থাক। সেসব নিয়ে আরো কিছু কথা বলবো, আগে সেই সাক্ষাৎ এবং এর আগে পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা জানাচ্ছি।    

দুই হাজার তেরো সাল, এক উত্তাল আন্দোলনের বছর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই সারাদেশ উত্তাল। গণজাগরণ মঞ্চে এক কাতারে সকলে। যেনো দ্বিতীয় এক মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তে প্রিয় মাতৃভূমি। এরও কিছুদিন আগে দুই হাজার বারো সালের পনেরো ডিসেম্বর দিদিকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বাংলানিউজে। শিরোনাম ছিলো: একাত্তরে সব হারিয়ে এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা। লিখেছিলেন রমেন দাশগুপ্ত। দিদিকে নিয়ে এই তথ্যবহুল বাঁক বদলের প্রতিবেদনটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। শতশত মানুষ দিদির সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। বলা যায়, দিদির জীবনে-দিদির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস বদলে এক অনন্য ভূমিকা রাখে এই প্রতিবেদনটি। শত শত শেয়ার হতে থাকে সেটি। অনেকে বাংলানিউজে ফোন করে দিদির সম্পর্কে জানতে চায়, দিদির পাশে থাকতে চায়। জানানো হয়-দিদি কারো দান নেন না। দিদি স্বনির্ভর স্বাবলম্বী, নিজের লেখা বই ফেরি করে চলেন। কেউ পাশে থাকতে চাইলে তাঁর বই কিনে পাশে থাকতে পারেন। এরপর সম্মতিতে আমার ফোন নাম্বার দেওয়া হয় দিদির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। আমাকে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই ফোন করেন। কেউ দিদির বই কিনতে চান, কেউ দিদিকে অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করতে চান। আমি তাঁদের সবাইকে জানাই দিদির অবস্থান। কেউ কেউ বই কেনেন কুরিয়ারের মাধ্যমে। এভাবেই চলছিলো।  

এক ছোট ভাই জুয়েল চৌধুরী। জুয়েলকে দিদি বলতেন, তুমি একটা সত্যিকারের জুয়েল। জুয়েল সামাজিক অনেক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টও। জুয়েল দিদির হয়ে একটা পেইজ খোলে। সেখানে দিদির বিভিন্ন তথ্য দেয়। আর বই কিনে দিদির পাশে থাকবার আমন্ত্রণ জানায় সবাইকে। অনেকেই সেই পেইজ থেকে দিদির সম্পর্কে জানতে পারে। দিদি তখন সেই বই বিক্রির টাকায় অনাথ আশ্রমের জন্য ঘর তৈরির কাজ শুরু করেন। জুয়েলের এই প্রচারণা কাজের জন্য প্রায় লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। যে টাকার কিছু দিয়ে দিদি নতুন করে বই ছাপানোর পুঁজি পায় এবং বাড়িতে আশ্রমের ঘর করার কাজে ব্যয় করেন। জুয়েল দিদির পাশে থেকে এক অনন্য কাজ করে।  

এরমধ্যেই ডিসেম্বরের তেইশ তারিখ দিদির সঙ্গে দেখা করতে, দিদিকে নিয়ে রিপোর্ট করতে আসেন এটিএন নিউজ থেকে মুন্নি সাহা। মুন্নি দি'র সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্য। প্রথম দিন মুন্নি সাহা দিদির রুমে তাঁর ইন্টারভিউ নেন। পরদিন যান দিদির গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায়। সেখানে দিদির ঘর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পোড়া-ভাঙাচোরা অংশ। দিদিকে যেখানে পাকিস্তানিরা নির্যাতন করেছিলো-দিদির খুড়োদের সেই ঘর। দিদির বাড়ির আশপাশ, ছেলেদের সমাধি, সব জায়গায় দিদিকে নিয়ে যান তিনি। দিদি কথা বলেন কাঁদেন, কষ্টে কাতরান। দুপুরে সেখান থেকে ফিরে দিদি বই বিক্রি করছেন খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে- সেই দৃশ্যও ধারণ করা হয়। আমি কীভাবে দিদির সঙ্গে যুক্ত হলাম সেই ইন্টারভিউও নেওয়া হলো। তুলে ধরা হয় আমি কীভাবে দিদিকে সঙ্গে নিয়ে পথে পথে বই বিক্রি করছি-সেই তথ্যও। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মুন্নি সাহা আমাদের সঙ্গে কাটালেন।  

দুই হাজার তেরো সালের জানুয়ারির এক তারিখ এটিএন নিউজ বছরের প্রথম ভিন্নধর্মী একটা নিউজ হিসেবে ভোর ছয়টার বুলেটিন থেকে প্রতিঘন্টা নিউজে দিদিকে নিয়ে করা রিপোর্টটি প্রচার করে। এই নিউজে দিদির কান্না সারাদেশের মানুষকে কাঁদায়। এর কয়েকদিন পরেই এটিএন নিউজের পাক্ষিক নিয়মিত আয়োজন 'এই বাংলায়' আধাঘন্টার অ্যাপিসোডে দিদিকে নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্টটি প্রচার করা হয়। এই রিপোর্টে দিদির আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান এবং দিদির স্বপ্ন-ইচ্ছা সবটাই তুলে ধরা হয় অনেকটাই নিখুঁতভাবে। দিদিকে নিয়ে আরো কিছু করার জন্য অনেকেই আসতে চান। যদিও এতে দিদির কষ্ট আর কান্না ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। সবাই চুকচুক করে দিদিকে নিয়ে আহা উহু করেন, কিন্তু দিদির স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে কেউ  সঙ্গী হয় না। দিদির জীবন তেমনই চলতে থাকে। কতজনকেই দিদি বলেন-একটা ভালো দেখে বাসা নিয়ে দেওয়ার জন্য। কেউ এগিয়ে আসে না। দিদি আর দিদির বিড়ালদের নিয়ে আমি পড়ে থাকি চেরাগী পাহাড়ে, লুসাই ভবনের সেই দশ ফিট বাই বারো ফিটের রুমটাতে।  

...জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফারজানা ববি নামের একজন চিত্র পরিচালক আসেন চট্টগ্রামে। দিদিকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি শর্টফিল্ম বানাতে চান তিনি। ফিল্মের নাম 'বিষকাঁটা'। সেই ফিল্মে আরো দুইজন বীরাঙ্গনার কথাও আছে। ববি ফিল্ম করবার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন চিত্রশিল্পী, লেখক, নির্মাতা গোঁসাই পাহলভি ওরফে সুমনের মাধ্যমে। সুমন আমাদের দীর্ঘ পরিচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার ছাত্র সুমন চেরাগী পাহাড় বঙ্গবন্ধু ভবনের ছাদে উদীচীর পাশের রুমে ব্যাচেলর থাকতো। আমাদের লুসাই ভবনের রুমে ছিলো তার প্রতিদিনের আসা-যাওয়া। তেরো সালে সুমন ছিল ঢাকায়। তার মাধ্যমেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফারজানা ববি। দিদি নিজের প্রচার পছন্দ করতেন না। সুমন অনুরোধ করায় দিদি ফারজানার প্রস্তাব ফেলতে পারেন নি। সেই শর্ট ফিল্মের শুটিং চলে দুইবারে-প্রায় দশ দিন। দিদি সেখানে অংশ নিলেও ছিলেন বিরক্ত। দিদির বাড়িতে গিয়ে কিছু দৃশ্য ধারণের কথা থাকলেও সেখানকার বিরূপ পরিস্থিতির কারণে যাওয়া হয়নি। এই শুটিং চলাকালীন দিদির একটা প্রিয় বিড়াল মারা যায়, তিনি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। শেষ পর্যন্ত অনেক অনুরোধ করে দিদিকে শেষ দিনের শুটিংয়ে সাগর পাড়ে নিতে হয়। 'বিষকাঁটা' ফিল্মটা শেষ পর্যন্ত বেশ ভালোই আলোড়ন তোলে দেশ-বিদেশে। জানুয়ারি মাসজুড়ে এই ফিল্ম নিয়ে ব্যস্ততায় কাটে আমাদের।  

ফেব্রুয়ারিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চে সবাই একাত্ম। এরমধ্যেই ফেব্রুয়ারির সাত তারিখ দিদিকে সংবর্ধনার জন্য আমন্ত্রণ জানায় সিলেট হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদ। ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তকে দিদি ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন এবং বাসায় গিয়ে দিদি মাঝে মাঝে তাঁকে বকেও আসতেন। রানা দাশগুপ্তের স্ত্রী রীতা দি ছিলেন দিদির বইয়ের পাঠক। সে কারণেই রানা দাশগুপ্তের বাসায় যেতেন দিদি। সবমিলিয়ে দিদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও না করতে পারেন নি সিলেট যাত্রাকে। এমনিতেই সিলেটে যাওয়া দিদির অনেকদিনের ইচ্ছে। একসময় দিদির জীবনে সিলেট পর্ব বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল। তাঁর প্রথম সন্তান সাগরের জন্ম সিলেটে। সেখানেই এক বান্ধবী জেবুন্নেসার খোঁজ অনেকদিন ধরেই পাচ্ছেন না দিদি। আমরা সিলেট গেলাম রাত নয়টার ট্রেনে। যদিও সেদিন ট্রেন ছাড়লো রাত বারোটায়। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি তাপস হোড়। তিনিই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। দিদির শর্ত ছিলো- সিলেট যেতে পারেন তবে তাঁর কাছ থেকে বই কিনতে হবে। আমরা অনেক বই সঙ্গে নিয়ে গেলাম, প্রায় পঁচিশ হাজার টাকার বই। সিলেটে আমরা ভালোভাবেই অনুষ্ঠান শেষ করে সেদিন রাতের বাসেই চট্টগ্রাম চলে আসি। যদিও কথা ছিলো পরের দিন আসবার কিন্তু দিদি বিড়ালের চিন্তায় আর থাকলেন না। সিলেটের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদ নেতারা দিদিকে ভালোভাবেই সম্মান জানালেন। আমাদের নেওয়া বইয়ের প্রায় সবগুলোই রেখে দিদির হাতে পঁচিশ হাজার টাকা দিলেন। আমাদের আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়াও দিলেন। সিলেট থেকে ফেরার পরই আন্দোলন পাল্টা আন্দোলনে সারাদেশই প্রায় অচল হয়ে গেলো। দিদির বই বিক্রি বন্ধ, আমাদের সব কাজকর্ম বন্ধ। আমিও গণজাগরণের একজন যোদ্ধা হয়ে পথে নামলাম।

পনেরো জুলাই দুই হাজার তেরো সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের রায় ঘোষণা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে গোলাম আযমের বয়স বিবেচনায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সত্ত্বেও নব্বই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই রায় মেনে নিতে পারেনি সারাদেশের গণজাগরণ মঞ্চসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে একাত্ম হওয়া জনসাধারণ। পাঁচ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে যে গণবিস্ফোরণ ঘটে সারাদেশে সেই বিস্ফোরণের একটাই দাবি- সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। গণ আন্দোলনের মুখে রায় পাল্টে যায়। অনেক বড় বড় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় হয় এবং কার্যকরও হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসির রায় না হওয়ায় সারাদেশে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভের জন্ম নেয়। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখাতে গিয়েই অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও অনেক দেশপ্রেমিক তরুণ দিদির ছবির সঙ্গে গোলাম আযমের ছবি পোস্ট দেয়। সেসব পোস্টে গোলাম আযমের বিকৃত ছবি এবং দিদির কান্নার ছবি দিয়ে লিখে দেয় "কেঁদো না মা আমরা জেগে আছি তোমার ছেলেরা। এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরবো না। " এই ধরনের শতশত পোস্ট ফেসবুকে ঘুরতে থাকে, শতশত শেয়ার হতে থাকে। একইসঙ্গে বাংলানিউজে করা দিদিকে নিয়ে প্রতিবেদন "একাত্তরে সব হারিয়ে এখন বইয়ের  ফেরিওয়ালা" প্রতিবেদনটিও আবার শেয়ার হতে হতে নতুনভাবে সবার সামনে আসে। ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দিদি যেনো হয়ে ওঠেন নবপ্রজন্মের অগ্নি মশালের স্মারক।  

আবার টনক নড়ে মিডিয়া রাজ্যে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নিষ্পেষিত সন্তান সম্ভ্রমহারা একজন অজ্ঞাত-প্রায় জননী রমা চৌধুরী আবার আলোয় আসেন। এক কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত এই প্রচারবিমুখ মানুষটি পথে পথে নিজের লেখা বই বিক্রি করে গড়ে তুলতে চান একটি অনাথাশ্রম। কারো কাছে দয়া ভিক্ষা না করে নিজের তৈরি পথে নিজের মত করেই জীবনচারী রমা চৌধুরীর জীবনালেখ্য হয়ে ওঠে অনেকের আগ্রহ ও গবেষণার বিষয়। ঊনিশ এবং বিশ জুলাই কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয় দিদিকে নিয়ে। এর দুইদিন পরে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম আসেন আমাদের রুমে দিদির কাছে। মুজাহিদ একটা প্রিন্ট কাগজ দেয় দিদিকে। সেখানে তৎকালীন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকির স্ত্রী মুজাহিদকে দিদির খোঁজ জানাতে বলেন এবং দিদির সঙ্গে খুব শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ করতে চান- এমন একটা ইঙ্গিত দেওয়া ছিলো। মুজাহিদের সেই যোগাযোগই আসলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিদির সাক্ষাতের প্রথম প্রচেষ্টা ছিলো, তা পরে আমরা জানতে পারি।

জুলাই মাসের চব্বিশ তারিখ আমার নাম্বারে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল।  তিনি ফোন করে দিদির সঙ্গে কথা বলেন। দিদিকে আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। দিদি বলেন, আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হলে কি হবে? আর তো কোথাও যাই না। আমার কয়েকটা পোষা বিড়াল আছে, তাদের একা রেখে আমি কোথাও যেতে পারি না। শাকিল ভাই বলেন, কিছু করার জন্য নয়, আপনাকে একটু দেখতে চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। দিদি বলেন, আমাকে দেখতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী আসুক আমার কাছে। আমি তাঁকে দুইটা ডালভাত রান্না করে খাওয়াবো! দিদি সহজ সরল মানুষ তাই সহজেই এমন কথা বলতে পারেন। শাকিল ভাই বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো একা কোথাও যেতে পারেন না, তাঁর সঙ্গে অনেক লোক যাবেন। দিদি একজন শিশুর মতই বলেন, যত লোক আসুক, আর্মি, পুলিশ যারাই আসুক আমার বিল্ডিংয়ের ছাদে সবাইকে বসাতে পারবো। আর সবাইকে খাওয়াতেও পারবো একবেলা। শাকিল ভাই দিদির শিশুসুলভ কথা শুনে আশ্চর্য হন, আবার বেশ মজাও পান। সেদিন তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে বিফল হলেও আমাকে জানিয়ে রাখেন দিদি মত বদলালে তাঁকে যেনো জানানো হয়। কিন্তু দিদি মত বদলান না। পরিচিত অনেকেই দিদিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। পরদিন শাকিল ভাইয়ের প্রতিনিধি হয়ে আসেন সাবেক ছাত্রনেতা সীমান্ত তালুকদার নিজেই। এসে সব খবরাখবর নেন দিদির। দিদি কীভাবে কোথায় থাকেন সব ছবি তুলে, ভিডিও করে পাঠিয়ে দেন শাকিল ভাইকে। সীমান্ত দা দিদিকে বারবার অনুরোধ করেন যেনো দিদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেদিনও শাকিল ভাই সীমান্ত দা'র ফোনে দিদির সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু দিদি অনড় থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। সীমান্ত দা আমাকে বলে যান, তিনি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন। আমি যেনো চেষ্টা করি দিদিকে রাজি করাতে। সীমান্ত দা বলেন, দিদি যেভাবে চান সেভাবেই নেওয়া হবে। চাইলে আপডাউন প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি বললাম- ঠিক আছে যেদিন গিয়ে সেদিন যদি ফিরতে পারেন তাহলে হয়তো রাজি হতেও পারেন। কিন্তু আমি সেদিন দিদিকে রাজি করাতে পারিনি।  

পরেরদিন শুক্রবার। আমাদের আগেই জানানো হয়েছে সাক্ষাৎপর্ব অনুষ্ঠিত হবে শনিবার, কিন্তু অন্তত দুইদিন আগে সেটা ফাইনাল জানিয়ে রাখতে হবে। শুক্রবার ছাব্বিশ তারিখ সকাল এগারোটার সময়ও ফাইনাল করতে পারিনি যাওয়ার বিষয়টা। অন্যদিকে সীমান্ত দা, শাকিল ভাই ফোনে খবর নিচ্ছেন। দিদির সিদ্ধান্ত জানতে চাইছেন, আমি কিছুই জানাতে পারছি না। শুক্রবার সকাল এগারোটার একটু পরে সুহৃদদের অনুরোধে দিদিকে রাজি হলেন। আমি শাকিল ভাইকে জানালে তিনি আবার কথা বলেন দিদির সঙ্গে। দিদি বলেন, আমি যেতে রাজি আছি তবে একটা শর্ত আছে আমার। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কিছু নিতে পারবো না। আমাকে তিনি দেখতে চাইছেন,  তাঁর অনেক কাজ। আমি শুধু দেখা করতে যেতে পারি। শাকিল ভাই মেনে নিলেন দিদির শর্ত। আমি সীমান্ত দা'কে জানালাম-দিদি রাজি হয়েছেন। সীমান্ত দা খুশি হলেন। তবে বলেন, এতো দেরি করেছেন এখন তো কোন ফ্লাইটের টিকিট পাবো না। আপনারা আজ রাতের ট্রেনেই রওয়ানা দেন, আমি আপনাদের জন্য প্রথম শ্রেণির একটা স্লিপার বুকিং দিচ্ছি। যেই কথা সেই কাজ। বিকেল চারটার মধ্যে সীমান্ত দা লোক পাঠালেন। দশ-বারোজন ছেলে আসলো। আমাদের ট্রেনের টিকেট দিলো আর বললো তারা আমাদের জন্য এখন থেকে পাশে থাকবে, যা দরকার হয় আমরা জানালেই হবে। রাত দশটায় ট্রেনে তুলে দেবে।

ওদিকে বাংলানিউজে খবর এলো, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন রমা চৌধুরী। সেই খবর দেখে কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্রেকিং নিউজ করেছে-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন রমা চৌধুরী। আমরা সবকিছু গুছিয়ে রাতের সাড়ে দশটার মেইলে একটা স্লিপিং বাথে রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে। দিদির বিড়ালগুলো রইলো রুমে বন্দি। সেই নিয়ে দিদির চিন্তা।

পরদিন সকাল সাতটায় ঢাকা এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামলাম আমরা। সেখানে সীমান্ত দা'র এক বন্ধু আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেলেন তাঁর উত্তরার বাসায়। সেখানে সীমান্ত দা ছিলেন। তিনিসহ আমরা গাড়িতে চলে গেলাম শাকিল ভাইয়ের বাসায়। শাকিল ভাইয়ের সরকারি বাসভবন গণভবনের কাছেই। সেখানে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। নাস্তা করলাম শাকিল ভাই ও তাঁর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে। শাকিল ভাই অসাধারণ একজন মানুষ, তাঁর স্ত্রীও খুবই সজ্জন এবং আন্তরিক। তাঁদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হলাম। সেখান থেকে সীমান্ত দা, তাঁর বন্ধু, শাকিল ভাই তাঁর স্ত্রী মেয়েসহ আমরা দুইটি গাড়িতে রওয়ানা হলাম গণভবনের উদ্দেশে।  

গণভবনে ঢোকার সময় অনেক ফর্মালিটি সামলে আমরা নামলাম গাড়ি থেকে গণভবনের সামনে। দিদির খালি পা সবার নজরে পড়লো। একজন সিকিউরিটি দিদিকে দেখিয়ে বললেন, উনি বোধহয় জুতা গাড়িতে রেখে এসেছেন। আমি বললাম- না উনি জুতা পরেন না। সিকিউরিটি ভদ্রলোক আশ্চর্য হলেন, আর কিছু বললেন না। তিনি কি করে জানবেন-একজন সন্তানহারা জননীর খালি পায়ের ইতিহাস! দিদি তাঁর তিন সন্তান হারাবার শোক এবং মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে থাকার যে পণ করেছিলেন তা আমৃত্যু পালন করে গেছেন। দিদি বলতেন, যে মাটির নীচে আমি আমার সন্তানদের রেখেছি সেই মাটির ওপরে আমার বুক দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া উচিৎ, আমি তো তবু পায়ে হাঁটি। সেই খালি পায়েই দিদি গণভবনে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।  

আমরা গণভবনের হলরুমে পৌঁছাবার একটু পরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এলেন। হলরুমে প্রধানমন্ত্রীর পাশের  চেয়ারেই বসতে দিলেন দিদিকে। দিদির পাশেই একটু সামনের চেয়ারে আমি বসবার সুযোগ পেলাম। সামনে দুইপাশে অন্য চেয়ারে বসলেন সীমান্ত দা, তার বন্ধু, শাকিল ভাই ও তাঁর পরিবার এবং অন্য আরো বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সেখানে ছিলেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিদির এবং আমাদের চল্লিশ মিনিটব্যাপি সব কথোপকথন রেকর্ড করা হয়। আমি একেবারেই পাশে বসার কারণ, দিদি কানে হিয়ারিং এইড দিয়ে কথা শুনলেও অনেক কথা বুঝতে সমস্যা হয়। দিদিকে তখন সেসব কথা শোনাতে হয়। আবার দিদি কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেললে আমাকে পথে ফিরিয়ে আনতে হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রথমে দিদির কুশল জানতে চাইলেন। আমি সহ সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। এরপর দিদির জীবনের সুখ-দুখের কথা জানলেন তাঁর কাছ থেকেই। মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রী আমার কাছ থেকেও জেনে নিলেন দিদি কীভাবে জীবনযাপন করেন, কোথায় থাকেন, আর কে কে আছে এইসব।  প্রধানমন্ত্রী দিদিকে বললেন- আপনি বই বের করেন, আপনার প্রকাশক কে? দিদি তখন আমাকে দেখিয়ে দিলেন। বললেন, ও হচ্ছে আলাউদ্দিন খোকন আমার প্রকাশক এবং আমার প্রতিনিধি। আমার বর্তমানে-অবর্তমানে ও-ই আমার সব কাজ করবে। খোকন শুধু আমার প্রতিনিধি নয়, ও আমার জীবনদাতা। দিদি কথা বলতে শুরু করলে আর থামেন না, স্থান কাল পাত্র ভুলে নিজের মতো করেই বলতে থাকেন। দিদি আরো বলেন, আমি সবকিছু হারিয়ে ওকে পেয়েছি, ও কতবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজ থেকে আপনি আমার বোন। আমি আপনার বড় বোন। আপনি ডেকেছেন-আমি এসেছি। এবার আমি ডাকবো আপনাকে, আপনিও যাবেন তো? প্রধানমন্ত্রী হেসে জবাব দিলেন- অবশ্যই যাবো।  

দিদি বললেন, আমি যুদ্ধের কারণে দুই ছেলেকে হারিয়েছি আর এক ছেলে আটানব্বই সালের ষোল ডিসেম্বর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি আমার সেই ছেলেদের স্মৃতির জন্য একটা অনাথ আশ্রম করতে চাই। আমার বই বিক্রি করেই সেই আশ্রম করবো। আমার বই বিক্রির টাকায় সেই আশ্রম চলবে। আমার আশ্রম উদ্বোধন করার জন্য আপনাকে আসতে হবে কিন্তু, বলে গেলাম আজ। প্রধধানমন্ত্রী খুশি হয়েই সেই প্রস্তাব মেনে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর কথা বললেন, তাঁর পরিবারের অন্য সবার কথা বললেন। দিদি আর প্রধানমন্ত্রী দুজনের দুঃখ ভাগাভাগি করে নিলেন। দিদি নিজের লেখা তিনটি বই 'একাত্তরের জননী ' 'এক হাজার এক দিন যাপনের পদ্য ' এবং 'ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ' প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিলেন। প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশ দিলেন, তাঁর লেখা বই যেনো দিদিকে একসেট দেওয়া হয় (যদিও প্রধানমন্ত্রীর সেই বই আমাদের কেউ দেয় নি)। প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত দা'কে দায়িত্ব দিলেন আমাদেরকে যেনো ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারে নিয়ে যান এবং সবকিছু ঘুরে দেখান। সেই কাজটা সীমান্ত দা করেছিলেন, আমাদের ফেরার পথে। দিদি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসেই উসখুস করছেন দেখে প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলে দিদি বলেন, আমি কয়েকটা বিড়াল রেখে এসেছি রুমে। ওদের দেখার কেউ নেই। আমাকে তাড়াতাড়ি সেখানে চলে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আশ্চর্যই হলেন মনে হয়। যেখানে সহজে মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরতে চায় না, আরো দুইটা বেশি কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত সবাই, সেখানে এমন পাগলও আছে! যে বিড়ালের চিন্তায় প্রধানমন্ত্রীকে সময় দিতে পারছেন না!  

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিদির সাক্ষাৎপর্ব শেষ হলে দিদি আমাকে বললেন প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করতে। আমি এই সুযোগ আর পাবো কিনা জানি না, তাই তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। আমি ধন্য হলাম। আমি একজন মহান মানুষ বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরির হাতের ছোঁয়া পেলাম। আমি যেনো সেই মহান নেতার স্পর্শ পেলাম।   

আমাদেরকে সীমান্ত দা এবং তাঁর বন্ধু গণভবন থেকে তাঁদের গাড়িতেই নিয়ে গেলেন ধানমণ্ডির বত্রিশ নাম্বারে। তার আগে শাকিল ভাই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন (এই ভালো মানুষটির সঙ্গে আর দেখা হলো না। দুই হাজার পনেরো সালের ডিসেম্বরে তিনি মারা যান)। আমরা কিছু সময় বত্রিশ নাম্বারে কাটিয়ে চলে গেলাম এয়ারপোর্টের কাছেই। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে খেতে টিভিতে দেখলাম, দিদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রচার কো হচ্ছে। এর আগেই গাড়িতে বসে অনেকগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমার সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য নিয়েছে। আমরা দেখলাম, প্রথম সংবাদ হিসেবেই দেখাচ্ছে দিদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতটা। আমরা সেখান থেকে এয়ারপোর্ট গিয়ে চারটার ফ্লাইটে চট্টগ্রাম চলে এলাম। আমার সেই প্রথম উড়োজাহাজে ওঠা। দিদি আমাকে পাশে বসে অভয় দিচ্ছেন, ভয় পেওনা। আমি কতবার চড়েছি। আমার বিড়ালও আমার সঙ্গে বিমানে ঘুরেছে। তুমি তো এই প্রথম, ভয় পেওনা কিছু হবে না। আমি যদিও ভয় পাচ্ছিলাম না, তবে দিদির এই আশ্বাসটুকুও উপভোগ করছিলাম। আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে নেওয়ার জন্য সীমান্ত দা'র পাঠানো সেই ছেলেরাই এলো একটু দেরিতে। আমরা সন্ধ্যায় ফিরে এলাম লুসাই ভবনে। তারপর শুরু হল অন্য কাণ্ড। সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত চললো একে একে বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার। পরদিন সকালবেলা ঘটলো অন্য আর এক ঘটনা।

ডাক্তার শাহানা বেগম। তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কয়েকদিন আগে। তাঁর যোগাযোগের প্রতিনিধি ছিলো চট্টগ্রামের কাট্টলির সঞ্জয় নামের একজন। সঞ্জয় এসে জানিয়েছিলো-ডাক্তার শাহানা আরো কয়েকজনকে নিয়ে দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। এই ভদ্রমহিলা এলেন আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবার পরেরদিন। আগের দিন জার্নির ধকলে আমরা ক্লান্ত, সেই সকাল সাতটায় তারা এলেন। ডাক্তার শাহানা এসেই দিদির সব দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। তিনি হয়ে উঠলেন দিদির একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী, একমাত্র অভিভাবক। ডাক্তার শাহানা বেশ মোটাসোটা মানুষ, আমাদের ছোট রুমে ঢুকেই ছোট খাটটাতে বসে দিদি সহ ভেঙ্গে পড়ে গেলেন। সেই খাটটা আর কখনোই আমরা সাড়াতে পারি নি। ডাক্তার শাহানা সারাদিন দিদির পাশে বসে থাকলেন। যত মিডিয়া আসলো, যতো মানুষ আসলো দিদিকে অভিনন্দন জানাতে-সবাইকে ডাক্তার শাহানা দেখালেন তিনিই দিদির সবকিছু!

সেদিন চেনা-অচেনা বহু লোক এলেন দিদিকে অভিনন্দিত করতে। আমি আমাদের রুমে জায়গা হবে না বলে পাশেই চট্টগ্রাম একাডেমির হল রুমটা নিয়ে রেখেছিলাম সাংবাদিক রাশেদ রউফ ভাইকে বলে। সেখানেই সবাই এলেন দেখা করতে ফুল হাতে। যারা এতোদিন দিদির কাছে পাশে আসেনি, দিদির একটা বই কিনে পাশে থাকেনি তারাই বেশি বেশি দিদির জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। দিদির সঙ্গে একটা শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবি তুলে ছুটলেন পেপার নিউজ করতে। ডাক্তার শাহানা তার সঙ্গে নিয়ে আসা আরো পাঁচ ছয়জন সহ দুইদিন দিদির অভিভাবক হয়ে থাকলেন পাশে, সব মিডিয়ায় তাকে দেখা গেলো। তিনি নিজেও বক্তব্য দিলেন কয়েক জায়গায়। তিনি বললেন, দিদির জীবন পাল্টে দেবেন। দিদির হাতে বিশ হাজার টাকা দিলেন, যা তাদের অনেকের সহযোগিতার মাধ্যমে সংগ্রহ করা। দিদি তো এমনি টাকা নেন না, বিশ হাজার টাকার বই দিলেন তাদের। যদিও তারা বলেছিলেন, সেই বইয়ের টাকা পাঠাবেন ঢাকায় গিয়ে। তবে তা আর পাঠালেন না কোনোদিন। ডাক্তার শাহানা দিদির অভিভাবক হয়ে একটা গ্রুপও খুলেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখান থেকেও তিনি দিদির নামে অনেক সহযোগিতা নিয়েছেন যা অনেক পরে আমি জানতে পারি। যখন সেটা বুঝতে পারি, তখনই তাদের এড়িয়ে যেতে থাকি। দিদিও তার ওপর এসব খবরদারি নিতে পারছিলেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবার পরে এমন আরো অনেক সুবিধাবাদীরা এসেছিলো-সহযোগিতার নাম করে নিজেদের ফায়দা কুড়াবার জন্য। দিদির নৈতিকতা ও আমার নিয়ন্ত্রিত বিবেচনা আর কঠোর অবস্থানের কারণে কেউ খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি।  

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গণভবনে নিয়ে গেলেন তাঁকে দেখার জন্য। দিদি নিজের আত্মসম্মানবোধ থেকে নিজের শত কষ্টের, শত যন্ত্রণার জীবনযাপনে থেকেও একবুক হাহাকার, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, চরম আর্থিক দৈন্যতার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কিছুই নিতে চান নি। তবে দিদির স্বপ্ন-সন্তানদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তোলার কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন। দিদি আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ, কারো দান নিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। তবু এ কথা বলতে হয়, দিদি বই বিক্রি করে চলেন এবং তাঁর স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার বই বিক্রির টাকা। তাই প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর আশপাশের কারো মনে হয় নি দিদির বই কিনে তাঁর পাশে থাকা যায়! দিদির কাছ থেকে বই কিনে পাশে থাকতে চাইলে কিংবা সেই প্রস্তাব দিলে দিদি ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কোনও সহযোগিতা নেন নি বলে সবাই  ধন্য ধন্য করেছে। কিছু পাওয়ার লোভ কখনো করেনওনি তবে তাঁর স্বপ্ন পূরণে কেউ সহযোগী হলে দিদি সানন্দেই রাজি হতেন। এরপরে দিদি দুই হাজার আঠারো সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। পরে অনেকবার অনেক মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েও বলেছেন, কেউ যদি তাঁর বই কিনে পাশে থাকে-তিনি সানন্দে দিতে চান।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবার পরে দিদি বেঁচে থাকতে আর কেউ কোনদিন খবর নেয়নি। কেউ একটু জানতে চায় নি তিনি কেমন আছেন! এমন কি দিদি যখন মৃত্যুশয্যায় তখনো বিছানায় শুয়ে অনেক মিডিয়াতেই বলেছেন, আমি আমার বোন প্রধানমন্ত্রীকে একটু দেখতে চাই। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিলো না। তেরো সাল থেকে আঠারো সাল এই কয় বছরে কেউ অন্তত দিদির আশ্রম গড়ার কাজে পাশে এসে দাঁড়ালেও তো দিদির স্বপ্ন সার্থকতা পেতে পারতো।  

দিদি চলে গেছেন আঠারো সালের তিন সেপ্টেম্বর। আশ্রম গড়ার স্বপ্ন এখন ধূলিস্যাৎ হওয়ার পথে। দিদি চলে যাওয়ার পরে তাঁর বই বিক্রিও স্থবির হয়ে গেছে। তিনি মারা যাওয়ার পরে বাড়িতে গিয়ে দিদির বাড়ি, যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পোড়া ঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স করবার আশ্বাস দিয়েছিলেন বোয়ালখালীর সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদল। তিনি নিজেই তো চলে গেলেন হঠাৎ। রমা চৌধুরীর স্মৃতিও একদিন মুছে যাবে। তাঁর মৃত্যুর পরে হলেও, তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় কিছু একটা করে তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইলে দিদির স্বপ্ন 'দীপংকর স্মৃতি অনাথালয়' গড়ে উঠতে পারে এখনো। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পোড়া ভিটে সংরক্ষণে ব্রতী হোক সবাই-সেটাই কামনা।  
 
লেখক: প্রয়াত রমা চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।