ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এ কোন অন্ধকারের পথে চলছে বাংলাদেশ?

সারওয়ার-ই আলম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২০
এ কোন অন্ধকারের পথে চলছে বাংলাদেশ? ভাঙচুর করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার ঘটনাকে যারা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছেন, যারা মনে করছেন এটা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের বিষয়, তারা সম্ভবত বিরাট  ভুল করছেন। কার্যত স্বাধীনতার স্থপতির ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার মধ্য দিয়ে সারা দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে মৌলবাদীরা এই কঠিন বার্তাটি দিল যে বাংলাদেশটাকে তারা শরীয়া আইনে পরিচালনা করতে চায়।

হেফাজতে ইসলাম ও তাদের অনুসারীরা এই দেশটাকে যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের আদলে পরিচালনা করতে চায় এটাই তার সুস্পষ্ট ইংগিত। এটাতো রীতিমত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। প্রগতিপন্থী ও  মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী কোন ব্যক্তির পক্ষে এটা কি কোনভাবে মেনে নেয়া সম্ভব?

উগ্রপন্থি মোল্লারা যা বলবে তা-ই মেনে নিতে হবে? এর মানে কি বাংলাদেশে ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ করা যাবে না? ঘরে-বাহিরে কোথাও কোনো মূর্তি বা স্ট্যাচু বসানো যাবে না? এভাবে চলতে থাকলে আগামীকাল তারা যদি ঘোষণা দেয় যে, বাংলার জমিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ মূর্তিপূজা করতে পারবে না, তখন কি তাও মেনে নিতে হবে? বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে গৌতম বুদ্ধের আবক্ষ ভাস্কর্য থাকে। এমন এক কঠিন দিন কি আসবে যেদিন গৌতম বুদ্ধের ভাস্কর্যও সরিয়ে  ফেলতে বাধ্য করা হবে?

আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোতে সুদ দেয়া-নেয়া হয়।  সুদ ব্যবস্থা হারাম বা নিষিদ্ধ ---এই কথা বলে উগ্রপন্থিরা বাবুনগরী, মামুনুল হকরা যদি কোনো একদিন আমাদের ব্যাংকগুলো ভেঙ্গে ফেলার জন্য ফতোয়া দিয়ে বসে তাহলে কি আমরা বিনাবাক্যে তা তামিল করবো?

নারী নেতৃত্ব হারাম বলে তারা যদি শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, রওশন এরশাদ, শিরীন শারমিন চৌধুরীর মত নেত্রীদেরকে সরিয়ে বাবুনগরী, মামুনুল হক ও তাদের সংগঠনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বসাতে চায়, তাহলে কি তাদের এই  অপ দাবি মেনে নিতে হবে? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ থাকবে না? সব কিছু কি এদের মতো উগ্রপন্থিদের দাবি মেনে করতে হবে?

আমাদের মুসলমান নারীরা কেউ বোরখা পরেন, কেউ পরেন না। তবে কি এমন একদিন আসছে যেদিন হেফাজতের জনসভা থেকে এমন ঘোষণা আসবে যে, প্রত্যেক মুসলমান নারীকে বাংলার জমিনে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই বোরখা পরে চলতে হবে; তা নাহলে হয়তো তাদের দোররা মারা হবে কিংবা ধর্ম অবমাননার কথা বলে শায়েস্তা করা হবে। এ আশংকা অমূলকও নয়।

হেফাজতের প্রাক্তন শীর্ষ ধর্মীয় নেতা সদ্য প্রয়াত আল্লামা শফি আহমেদ কোনোরূপ রাখঢাক না করে স্কুল কলেজগুলোকে 'জেনার বাজার' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন; কেননা তার ভাষায়, সেখানে ছেলে-মেয়েরা একসংগে পড়ালেখা করে। আল্লামা শফিদের দাবি মানতে গিয়ে আমরা কি বাংলাদেশে সহশিক্ষা বন্ধ করে দেবো?

চতুর্থ শ্রেণীর পর মেয়েদের স্কুলে যাওয়াটাকে আল্লামা শফি নাজায়েজ ঘোষণা করেছিলেন। তাহলে কি আমরা মুসলমান পরিবারের মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাবো না?

গার্মেন্টসে মেয়েরা দেহব্যবসা করতে যায় বলে জীবদ্দশায় তিনি মন্তব্য করেছিলেন। তাহলে কি হেফাজত একসময় গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে মেয়েদের কাজ করার ওপরও ফতোয়া জারি করবে?

একটি ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্নকে আজ জাতির সামনে এনে হাজির করেছে। ধর্মকে দাঁড় করে দিযেছে বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালির ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনা ও উদারনৈতিক মনোভাবের বিরুদ্ধে। এটা স্পষ্টত কোনো একটি নিগূঢ় অশুভ পরিকল্পনার অংশ, মৌলবাদীদের শক্তি প্রদর্শন। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে এসব প্রশ্নের যে উত্তরগুলো সামনে আসে তাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ শংকিত হতে হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন অন্ধকারের পথে চলছে বাংলাদেশ?

লণ্ডন, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

লেখক: লণ্ডন প্রবাসী কবি ও সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।