ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হায় মৃত্যু! তুমিই সত্য আর কিছু না

নঈম নিজাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২১
হায় মৃত্যু! তুমিই সত্য আর কিছু না নঈম নিজাম

হারুনের সঙ্গে দেখা উত্তরা ক্লাবে। একটা কাজে গিয়েছিলাম বিকালের দিকে।

হারুন লং টেনিস খেলে বেরিয়েছেন। শরীর থেকে ঝরঝর ঘাম ঝরছে। পরনে শর্ট প্যান্ট, পায়ে কেডস। দেখে মনে হলো না কোনো অসুখ-বিসুখ আছে। অভ্যর্থনা কক্ষে বসে কথা বলছেন তার ভাগ্নের সঙ্গে। আমাকে দেখেই বললেন, ‘ভাইছা কোত্থেকে আইলেন এই অসময়ে। এক কাপ কফি খাইয়া যান। ’ হারুনের কাছে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসলাম। আমার মুখে মাস্ক। কফি এলো। দুজন একসঙ্গে বসে কফি শেষ করলাম। হারুন উচ্ছল ছিলেন। চলাফেরায় একটা ভাব ছিল। বললেন, আমাদের বন্ধু ইব্রাহিম (এমপি চাটখিল) ঘরে ঢুকে গেছেন। বিশাল হুজুর হয়ে গেছেন। দাড়ি রেখে নামাজ কালেমা ধরেছেন। দুনিয়া নিয়ে ভাবনা বদলে গেছে। আমি বললাম, অনেক দিন দেখা হয় না। ফোন করেন মাঝেমধ্যে। হারুন আবার বললেন, দেখলে চিনবেন না। করোনা সব বদলিয়ে দিয়েছে। আপনার শরীর কেমন এখন? করোনা হওয়ার পর অনেকের শরীর দীর্ঘদিন দুর্বল থাকে। বললাম, শরীর এখন ভালো। অফিস করি পুরো সময়। বাসায় যাই। এই তো আছি। তবে আমারও অনেক ভাবনায় পরিবর্তন এসে গেছে। দুই দিনের দুনিয়া। ভালো লাগে না অনেক কিছু। মনে হয় আজ আছি কাল নেই। হারুন বললেন, ভাই, একটা কথা বলি। হাঁটাচলা করবেন। বেঁচে থাকতে হবে আপনাদের। দেখেন না আমি টেনিস খেলে এলাম। শরীর পুরো ফিট। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। গ্রামেও যাই। বললাম, সাবধানে থাকবেন। বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কিছু দিন পরই শুনলাম হারুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ফোনে কথা হলো। বললেন, এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আড়াই মাস চিকিৎসা নিলেন হারুন। না, ফিরলেন না আর। চলে গেলেন চিরতরে না-ফেরার দেশে। আর আসবেন না। দেখা হলে বলবেন না, ভাইছা কেমন আছেন?

হারুনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলে। ব্যবসা করতেন। বিয়ে করেছিলেন কর্নেল (অব.) সরোয়ার হোসেন মোল্লার মেয়েকে। সরোয়ার ভাই রক্ষীবাহিনীর তিন শীর্ষ কর্মকর্তার একজন ছিলেন। পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। দারুণ মানুষ। বাংলাদেশ প্রতিদিনে রক্ষীবাহিনীর সেই দিনগুলো নিয়ে লিখেছেন। টেনে এনেছেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতার কথা। সরোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক আড্ডা হতো আগে। এ কারণে হারুনকে মজা করে জামাইও ডাকতাম। হারুন হাসতেন। বলতেন, কী আর করব, শ্বশুর-জামাই দুজনের সঙ্গেই আপনি চলেন। আহারে হারুনের সেই হাসিমাখা মুখ আর দেখব না। মানুষের এই জীবন এত ছোট কেন হয়? একটা কচ্ছপও সাড়ে তিন শ বছর বাঁচে। আর মানুষ চলে যায় বড় আগে। কিছুই করার থাকে না। করোনায় আরও কঠিন বার্তা পেয়েছে মানব জাতি। আজ আছি কাল নেই। দুনিয়ার কোনো হাসপাতালই এখন আর শেষ ভরসা নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রশ্নের বাইরে নয়। ডাক এলেই চলে যেতে হয়। চলে যেতে হবে। এক মুহূর্তও থাকার সুযোগ নেই। করোনাকাল আমাদের অনেক কিছু জানিয়ে দিয়ে গেছে।

সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মনিরুজ্জামান ভাই আমাকে স্নেহ করতেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কলাম প্রকাশের পরই ফোন করতেন। বলতেন, তোমার লেখাটা এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম। দারুণ লিখেছ। সাহস করে এখন কেউ আর সত্য বলতে চায় না। লিখতেও চায় না। আপনজনদের ভালোর জন্যই সত্যটা বলতে হবে কাউকে না কাউকে। সত্যিকারের কাউকে পছন্দ করলে তার ভুলটা অবশ্যই ধরিয়ে দিতে হবে। এখন সবাইকে খুশি করার কথা বলি আমরা। ক্ষমতা দেখলে নতজানু হয়ে কদমবুচি করি। আত্মমর্যাদার জায়গাটুকু আর নেই। সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা ভেঙে দিতে হবে। মনির ভাইয়ের ফোন ভালো লাগত। তিনি পরামর্শ দিতেন। উৎসাহ জোগাতেন অনেকটা বড় ভাইয়ের মতো। এভাবে পরামর্শও সবাই দিতে পারেন না। এ পেশায় বড় জটিল সবকিছু। মনির ভাই আলাদা ছিলেন। সেই মানুষটা হুট করেই চলে গেলেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। প্রথম দিকে কিছুটা জটিলতা ছিল। শেষ দিকে অবস্থার উন্নতি হয়। মাহফুজ আনাম ভাই ফোন করেন তাঁকে। তাঁরা দুজনই বন্ধু ছিলেন। আমিও খোঁজ নিলাম। আমাদের বললেন, ভালো আছেন। হাসপাতালে কিছু দিন আরাম-আয়েশে থেকে বেরিয়ে আসবেন। কথার মাঝে রসিকতা, মজা ছিল। তারপর বললেন, চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক দিন থাকতে হবে হাসপাতালে। চিন্তা আসলে করিনি। ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে। মনির ভাই আবার ফিরে আসবেন আগের মতো করে। বাস্তবে কিছুই ঠিক ছিল না। হুট করে চলে গেলেন মনির ভাই। খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ। কিন্তু সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ী নেই। সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় চারদিকে মোশতাক আর মীরজাফর দেখি। মানুষ দেখি না। আপন-পর চেনা বড় কঠিন। এ কঠিনতম সময়ে একজন প্রিয় মানুষকে হারানো যে কতটা কষ্টের কাউকে বোঝানো যাবে না। মনির ভাই যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন। মন থেকে আপনার জন্য প্রার্থনা করছি।

মিজানুর রহমান খানের কথা এবার বলছি। একজন পেশাদার সাংবাদিক। মন দিয়ে সাংবাদিকতাই করেছেন অন্য কিছু করেননি। দলবাজির এ যুগে পেশা অনেক আগে হারিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সাংবাদিকরা এখন দলই করেন। অন্য কিছু করার সময় পান না। দলদাস আর দলকানাদের যুগে মিজান আলাদা ছিলেন। সাতেপাঁচে জড়াতেন না। কাজ করতেন মন খুলে। মাঝেমধ্যে টেলিভিশন টকশোয় আসতেন। কথা বলতেন বিশ্বাস থেকে। লিখতেন আইন-আদালত, বিচার বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সংবিধানকে সহজভাবে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। এক দিনে মিজান এ জায়গাটুকু তৈরি করেননি। দীর্ঘ সময় নিয়েছেন। তিল তিল করে একটা জায়গা তৈরি করেছিলেন এ পেশায়। সেই মিজান আক্রান্ত হলেন করোনায়। বয়স এমন আর কী হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। চিকিৎসা শুরু হলো। শেষ দিকে অবস্থার অবনতি হয়। হাসপাতালও বদল হয়। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। মিজান ফিরলেন না। চলে গেলেন। কথা বলার আরেকজন স্পষ্টবাদী মানুষ থাকলেন না। এ কঠিনতম সময়ে একজন মিজানকে দরকার ছিল সাংবাদিকতা পেশার জন্য। তাঁর মৃত্যু গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করল এ পেশাকে। এ ক্ষতি সহজে পূরণের নয়।

করোনাকালে আমরা আরও অনেক সাংবাদিক হারিয়েছি। শুরুর দিকে চলে যান এ পেশার সামনের সারিতে কাজ করা অনেক যোদ্ধা। আবার অসুখ-বিসুখেও অনেকে চলে গেছেন। কবি মাশুক চৌধুরীসহ অনেক সহকর্মীকে হারিয়েছি। হুমায়ূন কবীর খোকনকে স্নেহ করতাম ভাইয়ের মতো। খোকন মানত বড় ভাই হিসেবে। শুরুর দিকেই খোকন চলে যান। খোকনের মৃত্যু একটা ধাক্কা ছিল আমার জন্য। তখন হাসপাতাল ছিল না। ডাক্তার ছিল না। সবখানে একটা কঠিন পরিবেশ। সে পরিবেশ কীভাবে মানুষ সামলাবে সেই টেনশন ছিল। নিজেও অসুস্থ হয়ে টেনশন নিয়ে হাসপাতাল খুঁজতে থাকি। একটা জটিল অবস্থা। এখনকার সঙ্গে মেলালে চলবে না। হাসপাতাল পাই না। কী যে একটা অবস্থা ছিল। কোনো বাড়িতে করোনা রোগী আছে শুনলেই লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হতো। মানবিকতা হারিয়েছিল মানুষ। আপন-পর চেনার একটা সুযোগ ছিল। কষ্টের একটা সময় গেছে। প্রায় রাতে মনে হতো কালকের দিন বাঁচব তো? শ্বাসনালি, ফুসফুস ভাইরাস শেষ করে দেয়নি তো? ভয়ংকর একটা আতঙ্ক। নিঃশ্বাস কমে এলে ধরেই নিতাম চলে যাচ্ছি। আর ফিরে আসব না। ভোররাতে পাখির ডাকের শব্দ আর কোনো দিন শুনব না। আজানের ধ্বনিও কানে আর বাজবে না। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ফেরত এসে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছি। পরিবার-পরিজন পাশে ছিল। বন্ধুরা খোঁজ নিত। সেই কঠিন সময়টুকু পার করেছি। করোনা থেকে ভালো হওয়ার পর পীর হাবিব, নুর মোহাম্মদ আর শাম্মী সিদ্ধান্ত নিলাম প্রতি শনিবার দুপুরে একসঙ্গে খাব। মাঝেমধ্যে অন্য বন্ধুদেরও ডেকে আনব। চলছিল ভালোই। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। একদিন পীর হাবিব অসুস্থ হলেন। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য চলে গেলেন মুম্বাই। আমরা থমকে গেলাম। শনিবার আর দেখা হয় না আমাদের।

ছোট্ট একটা জীবন। এ জীবনে কোনো কিছুরই হিসাব মেলে না। মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী সৈয়দ লুৎফুল হকের সঙ্গে করোনাকালে বারবার দেখা হতো প্রেস ক্লাবে। কথা হতো। এক বিকালে চায়ের আড্ডায় তিনি আমাকে বললেন, ভোট নিয়ে বেশি টেনশন কোরো না। ফরিদা জিতবে। সেই লুৎফুল হক চলে গেলেন হুট করে। বড় অদ্ভুত একটা সময় যাচ্ছে। ঘুম ভাঙে ভয় নিয়ে। প্রতিদিনই চেনাজানা মানুষের চলে যাওয়ার খবর পাই। এ দুনিয়ায় তারা ছিলেন, আজ নেই। এ সময়টা কবে শেষ হবে জানি না। অনেকে মনে করেন ভ্যাকসিন সবকিছু বদলে দেবে। আমার তা মনে হয় না। সময় লাগবে। সাবধানে থাকতে হবে। দুুনিয়ার সব মহামারী ঠিক হতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। মানুষের বেঁচে থাকতে একটা বিশ্বাসের দরকার হয়। আমরাও একটা বিশ্বাসের মাঝে বেঁচে আছি। না, কোনো আক্ষেপ নেই। জানি মানুষের মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুকে এড়ানো যায় না। তার পরও আশার আলোটুকু সবাই জ্বালিয়ে রাখে।

সেদিন গ্রামে গিয়েছিলাম। মানুষ হাঁটছে, ঘুরছে, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। কোনো চিন্তা নেই। ভাবনা নেই। কারও মুখে মাস্ক নেই। করোনার অস্তিত্ব নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই। সবকিছুই যেন স্বাভাবিক। কুমিল্লা শহরের চিত্রও একই মনে হলো। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা বললেন, গ্রামে কোনো করোনা নেই। কোথাও সমস্যা নেই। কৃষক ভোরে খেতে যাচ্ছেন। চিন্তা করছেন নতুন ফসল নিয়ে। করোনা নিয়ে ভাবনার সময়টুকু কোথায়? জীবন ও মৃত্যু দুই সহোদর। কেউ কাউকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না। একসঙ্গে হাঁটছে হাত ধরে।  আমরা বেদনায় সিক্ত হয়ে তাদের অনুসরণ করছি। আর কিছু না।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।