ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বাধা দেওয়া বড় অন্যায়

আমিনুল হক বাবু  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৯ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২১
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বাধা দেওয়া বড় অন্যায় আমিনুল হক বাবু

দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন সেটা নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক বেশ পুরনো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আমরা দেখে আসছি, দেশে একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক উল্টো মামলা দিয়ে সাংবাদিকদেরই হয়রানি করা হয়। এরপরও বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। এর কারণ হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলে আসছেন, সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ এবং মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে। যার কারণে গণমাধ্যমের এত বিস্তৃতি।

এ কথাও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকবান্ধব একজন সরকারপ্রধান। করোনা সংক্রমণের এ দুঃসময়ে দেশব্যাপী সাংবাদিকদের সহযোগিতার জন্য ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’কে প্রধানমন্ত্রী ২০ কোটি টাকা দিয়েছেন। গণমাধ্যমের যেকোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং সংবেদনশীল হিসেবে আমরা দেখে আসছি। এরপরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে সাংবাদিকরা নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। যদিও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। বিএনপির আমলে সাংবাদিক শামসুর রহমান, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে করা হয়েছে নির্যাতন।  

বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেন? চলতি বছরের ২০ এপ্রিল রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এর আগের বছরের তুলনায় আরও এক ধাপ পিছিয়ে ১৫২-তে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালেও যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম। তালিকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে এবং সবার নিচে অবস্থান করছে ইরিত্রিয়া।

বার্তাসংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার একটি বার্ষিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সাংবাদিকতা করতে হয়। আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭৩টি দেশে সাংবাদিকতা পুরোপুরি অথবা ভয়াবহভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার। এ ছাড়াও, ৫৯টি দেশে রয়েছে কঠোর বিধি-নিষেধ। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে অনেক দেশের সরকার সাংবাদিকতার ওপর দমন-পীড়নের মাত্রাও বাড়িয়েছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার এবং মামলা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। সচিবালয়ে রোজিনাকে বেআইনিভাবে ৫ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। ওই সময়ে রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি করা হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুই ধরনের আইনে। দণ্ডবিধির ৩১৯ ও ৪১১  এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায়। দণ্ডবিধির ওই ধারায় প্রকাশ্য কোনো জায়গা থেকে কিছু চুরির কথা বলা হয়েছে। আর অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারায় গোপন কোনো জায়গা থেকে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপুর্ণ নথি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই দুইটি ধারা একসঙ্গে প্রয়োগ সাংঘর্ষিক।

রোজিনাকে হয়রানির উদ্দেশ্যের বড় প্রমাণ মেলে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদনে। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, আসামির (রোজিনা) কাছ থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করা হয়েছে তা প্রচার হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণেই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।

‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি’ চুরির ঘটনায় ‘হাতেনাতে' যদি আটক করা হয় তাহলে তো চুরির মালও উদ্ধার হয়ে গেল। তারপরও রিমান্ড চাওয়ার উদ্দেশ্য কী? যদিও মামলার অভিযোগের সঙ্গে যে জব্দ তালিকা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে সেই ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি’ নেই বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম মুঠোফোনের মাধ্যমে গোপনে সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একান্ত সচিবের কক্ষে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তুলছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর নথি সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে ফেলে রাখা দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার শামিল। কারণ, সেখানে সাধারণত অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীরা অবস্থান করেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর গোপনীয় নথি তারা কীভাবে অনিরাপদে রাখলেন? স্পষ্টত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হয় দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, অথবা তাদের উত্থাপিত অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে জনমনে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া একজন সাংবাদিক কোনো অন্যায় করলে তাকে তৎক্ষণাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ না করে ৫ ঘণ্টা মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজটা কঠিন। পৃথিবীর সব দেশ হিমশিম খাচ্ছে করোনা মোকাবিলায়। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। সবাই সবার জায়গা থেকে চেষ্টা করছে করোনা মহামারি মোকাবিলায়। বাংলাদেশ সীমিত সামর্থ্যে চমৎকার কাজ করছে। টিকার অতি দ্রুত বণ্টন তার সাক্ষী। তবু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকতে হয়। ভুল ধরিয়ে দিলে সচেতন হয়ে আরও উন্নতি করতে পারে সবাই।  

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টিকার চুক্তি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় টিকা পাওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে- প্রায় ২ সপ্তাহ আগে এমনটিই বলেছিলেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত বুধবার বাংলাদেশ চুক্তির জন্য যে নথিতে সই করেছে, তাতে আবার ইংরেজি ভাষার অংশের বদলে চীনা ভাষার অংশে সই করে ফেলেছে। সেই অংশে কী আছে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চীনা ভাষায় দক্ষ একজন অধ্যাপককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এমন অবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটি করছে। চুক্তি, টিকা কেনা ও আনার সব দায়িত্ব পালন করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। চীনের সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তি ও প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যে সময়ক্ষেপণ করছে, তাতে হতাশা প্রকাশ করেছেন বেইজিংয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, একই ধরনের ঘটনা ঘটছে রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রেও।

করোনার কারণে জনস্বাস্থ্য খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন। এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সব রিপোর্টের কারণে যারা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, রোজিনা ইসলাম কী তাদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন? কেননা তাকে যেভাবে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছে, সেটার কোনো কারণ ছিল না।  

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। তার সুনাম দেশে ও দেশের বাইরে। সাংবাদিকতার জন্য বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তার সাংবাদিকতার মূল শক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তিনি অনেক কিছু উন্মোচন করেছেন এবং তার প্রতিবেদন ধরে সরকার সংশোধনমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে। তার সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে মানুষ উপকৃত হয়েছে, সাংবাদিকতা উপকৃত হয়েছে, দেশ উপকৃত হয়েছে। বিনিময়ে তাকে আমরা দিলাম কারাগারের বন্দিজীবন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষুণ্ন হয়েছে রাষ্ট্রের সুনাম।

দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। তাই সহজেই চুরি, ডাকাতিসহ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আসামি করা যায় সাংবাদিকদের। যার কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ সংকুচিত হচ্ছে।

নন্দিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বহুবার বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র রয়েছে, সেখানে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় কম। যেখানে গণতন্ত্র নেই এবং স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, সেখানে অনাহারে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন ভারত ও চীনের। স্বাধীন ভারতের কোথাও যখনই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে তা নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় সরকার অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। তাতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং প্রাণহানি ঘটেছে কম। চীনের বহু অঞ্চলে একসময় দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে, স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকায় সেই মৃত্যুর কথা বাইরের মানুষ জানতে পারেনি। সরকার ব্যবস্থা নেয়নি।

একটি দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকলে সেখানকার মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার এবং তার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা। আমি মনে করি, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বাধা দেওয়া বড় অন্যায়। দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ যাতে ক্রমাগত সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে না পড়ে সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে দেশবাসী সবসময় সোচ্চার থাকা প্রয়োজন। নয়তো স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমে পেশাদার সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংখ্যা কমে যাবে। যা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর জন্য বড় ধরনের ক্ষতি।

লেখক: গভর্নর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।