ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?

সাইদুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২১
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?

দেশে নিরাপদ ও জনবান্ধব সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়েই উঠছে না। তেমন কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান নয়।

সড়কে গণপরিবহন যেমন চলছে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে, তেমনি অধিকাংশ ব্যক্তিগত যানবাহন চলছে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। ফলে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা, গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি নিত্যদিনের দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়গুলো যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। দেশে বড় ধরনের কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনবিক্ষোভ তৈরি হলে সরকার সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে তৎপরতা দেখায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নানারকম প্রতিশ্রুতি দেন, কমিটি গঠন করেন, বৈঠক করেন, সুপারিশমালা তৈরি করেন। অতঃপর এসব তৎপরতার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটলে মানুষের মনোযোগ সরে যায়, সেই সুযোগে কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও থেমে যায় এবং বিরামহীনভাবে ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা, চলতে থাকে নানারকম অনিয়ম। এভাবেই চলছে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা।

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় চলমান এমন নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। সে এক অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দেশে প্রথমবারের মতো ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করলে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যানবাহন আটকে যায়। শিক্ষার্থীদের সেই অহিংস স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল দেশের সড়ক পরিবহন খাতের দায়হীন, মায়াহীন সংকটাপন্ন চেহারা। ব্যাপক জনসমর্থিত সেই আন্দোলন চলাকালে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহবান জানায়।  

শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায়, কিন্তু সড়কে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” দ্রুততার সাথে সংসদে পাস করে। দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল নতুন আইনের মাধ্যমে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু হয়নি। কারণ অদ্যাবধি আইনটির বাস্তবায়নই শুরু হয়নি। এটি সরকার এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবকেই দৃশ্যমান করে তোলে।

অবাক ব্যাপার হলো, সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করার কয়েক মাস পরই ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি “জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল” শাজাহান খানকে প্রধান করে “সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি” নামে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১১১টি সুপারিশ তৈরি করে ঐ বছরের ২২ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। সেই সুপারিশসমূহে নতুন কিছু ছিল না, পুরনো কথাই নতুন করে লেখা হয়েছিল। সেখানে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতি কোনো নির্দেশনা ছিল না, চাঁদাবাজি বন্ধেও ছিল না কোনো পরামর্শ। শুধু জনসচেতনতা ও অবকাঠামোগত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকার আবার টাস্কফোর্স গঠন করে। অর্থাৎ শুধু কমিটি আর কমিটি। অবশ্য সেই সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদে পাসকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন বাস্তবায়ন না করে কেন আবার নতুন কমিটি গঠন এবং সুপারিশ তৈরি করা হলো? এটি একটি বড় প্রশ্ন। এসব উদ্যোগ “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ বা অনীহারই নামান্তর।

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধির বিধান থাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা শুরু থেকেই আইনটি বাস্তবায়নে আপত্তি করতে থাকেন। আসলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নিজেদেরকে আইনের উর্ধ্বে রাখকে বা ভাবতে পছন্দ করেন। তারা সবসময় জোর করে, ধর্মঘটের মাধ্যমে মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চান। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক আচরণ! 

উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহন আইনে অপরাধের সাজা ও জরিমানার পরিমাণ কমানোর জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে সরকারের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন, সাজা ও জরিমানার পরিমাণ কমিয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুই ঠিক মতো প্রকাশ করা হয় না। এই মুহূর্তে আইনটির কী অবস্থা তাও আমরা জানি না। তাছাড়া সংসদে পাসকৃত একটি আইনের ধারা-উপধারা এভাবে পরিবর্তন করা বিধিসম্মত কিনা সেটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ। যে কোনো আইন প্রয়োজনের তাগিদে সংশোধন করা যায় এবং করতে হয়, তবে তার নিয়ম আছে। আইনটির সকল অংশীজনের উপস্থিতি এবং মতামতের ভিত্তিতে তা করতে হয়। আসলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন বিষয়ে এসব করছে সময়ক্ষেপণের জন্য, তারা হয়তো আইনটির বাস্তবায়নই চান না। সরকারও তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। মোটরযান অর্ডিনেন্স অ্যাক্ট-১৯৮৩ তে দুর্ঘটনায় দোষী চালকের সাজার পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু সেই আইনও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তির কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত সড়ক পরিবহন আইন সবসময়ই কাগজে থাকে, বাস্তবায়ন পর্যায়ে থাকে না।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তারা পরিবহন সেবার মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আমাদের প্রত্যহিক জীবনব্যবস্থা সচল রাখেন। তাই আমরা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে নয়। কোনো অন্যায্য আইন তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতিও নয়। কিন্তু মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে বলতে হবে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে কোন বিধানগুলো তাদের পেশাগত অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে, জীবনকে বিপন্ন করবে। এ বিষয়ে সরকারের সাথে তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের দরকার নেই, সকল পক্ষের অংশগ্রহণে আলোচনা হতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তা ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, সড়ক ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি এবং সরকার- সকলে একসাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছে আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। সাজা ও জরিমানার পরিমাণ যাই নির্ধারিত হোক না কেন, তা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে আমরা আইনে জামিন অযোগ্য ধারা চাই না। কারণ এটা আইনের মৌলিক নীতি বিরোধী এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। জামিন পাওয়া একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনি অধিকার। আমরা চাই সহনীয় আইন, কিন্তু কঠোর বাস্তবায়ন। কারণ বাস্তবায়ন না হলে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থেকেই লাভ কী? আইন মেনে পরিবহন মালিকরা সুষ্ঠুভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবেন, শ্রমিকরা নিরাপদে তাদের পেশাগত জীবন নির্বাহ করবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কোনো অবস্থাতেই নৈরাজ্য সমর্থন করা যায় না। বিভিন্ন ধারা ও বিধানের বিষয়ে আপত্তি তুলে অনির্দিষ্টকালের জন্য আইনটি অকার্যাকর করে রাখার কোনো যুক্তি নেই, অধিকারও নেই।

উল্লেখ্য, দীর্ঘকাল ধরে আদর্শহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটই গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা। সড়ক দুর্ঘটনারোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা সুপারিশ করেছিলেন, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ এই বেপরোয়া চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে আলোর মুখ দেখেনি। এরা নিজেদের হীনস্বার্থে গণপরিবহনে নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখে। কারণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে চাঁদাবাজি-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ‘যত বেশি অব্যবস্থাপনা-নৈরাজ্য, তত বেশি অবৈধ উপার্জন’-এটাই তাদের অপকৌশল। গণপরিবহন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদাবাজি প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে হয়। এক. দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা, দুই. বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা, তিন. রাজধানী ও এর আশেপাশে কোম্পানীর অধীনে বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেট পাস চাঁদা। এর বাইরেও বহু রকমের চাঁদা রয়েছে এবং এসবের সাথে প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের লোকজন জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে রশিদ ও স্লিপ লিখে চাঁদাবাজি চলে। এই চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা বহুদূর পর্যন্ত যায়, অনেকেই পান। মানুষের করের টাকায়, বৈদেশিক ঋণের টাকায় সড়ক নির্মাণ করা হয়। এই সড়কে চাঁদাবাজি চলে কোন যুক্তিতে? কোন নৈতিকতায়? অথচ সরকার চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ফলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলাও গড়ে ওঠে না। এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট পরিবহন শ্রমিকদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। শ্রমিক নেতারা শ্রমিকদের নিয়োগ, বেতন, কর্মঘণ্টা, প্রশিক্ষণ, সড়কের উন্নয়ন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন জোরালো দাবি করেন না। আবার শ্রমিকরাও তাদের জীবন-মান উন্নয়নের স্বার্থ না বুঝে এসব কতিপয় স্বার্থান্বেষী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কৌশলের ফাঁদে পড়ে অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হন। সবসময় তারা আইনি শাস্তির বিষয়টি সামনে নিয়ে আন্দোলন করেন। অথচ গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে, চালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলে, সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে দুর্ঘটনা একবারেই কমে আসবে, তখন শাস্তির বিষয়টি মামুলি হয়ে পড়বে- এটা তারা বুঝতেই চান না।

এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গণপরিবহন খাতে নৈরাজ্যকর আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে বিআরটিসির পরিবহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এদের যোগসাজশে বিআরটিসির কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি পুরো প্রতিষ্ঠানকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। “অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ”-স্লোগান গায়ে লিখে বিআরটিসির বাসগুলো লোকসানের দিকে ছুটছে। জনগণের টাকায় কেনা শত শত গাড়ি মেয়াদ পূরণের আগেই নষ্ট হয়ে ডাম্পিংয়ে চলে যায়। টিকে থাকাগুলোর বেশিরভাগই সাধারণ যাত্রী বহন না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাড়ায় চলে। বিআরটিসি আন্তঃজেলা পর্যায়ে বাস পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কিছু মালিক-শ্রমিক সংগঠন বিরোধিতা করে, বাস ও কাউন্টার ভাঙচুর করে। অথচ সরকার এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।  

বিআরটিএ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রস্তাবিত কোম্পানিভিত্তিক রুট ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধতিটি অসৎ সিন্ডিকেটের কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ এতে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির সুযোগ কমবে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন কর্তৃপক্ষ- ডিটিসিএ প্রায়ই নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থা বিষয়ে বৈঠক করে, এসব বৈঠকে কী উপকার হয়-তা দৃশ্যমান নয়।

সড়ক-মহাসড়কে অসহনীয় যানজট, গণপরিবহন যাত্রীবান্ধব ও সহজলভ্য না হওয়া ইত্যাদি কারণে নগরে, শহরে ও গ্রামে মোটরসাইকেল ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের বড় অংশ কিশোর- যুবক। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে ইদানিং সড়ক দুর্ঘটনা চরম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে রাজনৈতিক মোটরসাইকেল সংস্কৃতিও বেড়েছে। এসব মোটরসাইকেলের চালক ছাত্র-যুবরা আরও বেপরোয়া। মোটরসাইকেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে যেসব ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করে তা খুবই উশৃঙ্খল এবং অসচেতনতামূলক।

সারা দেশে ব্যাটারিচালিত স্বল্পগতির ইজিবাইক, অটোরিকশা, স্থানীয়ভাবে তৈরি নসিমন, ভটভটি, আলমসাধু, মাহিন্দ্র, বোরাক, টমটম, চান্দের গাড়ি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলছে। গ্রামে-শহরে স্বল্পদূরত্বে চলাচল এবং পণ্য পরিবহনে এসব যানবাহন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মহাসড়কের পাশ দিয়ে সার্ভিস রোড না থাকায় এসব যানবাহন বাধ্য হয়ে মহাসড়ক ব্যবহার করছে এবং অহরহ দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটছে ধীরগতির এই যানবাহনের সাথে দ্রুতগতির মোটরযানের সংঘর্ষে। হাইকোর্ট মহাসড়কে এসব চলাচল বন্ধে রায় দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রথমত, এই খাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে; দ্বিতীয়ত, এসব যানবাহনের ওপর ভিত্তি করে একটি শক্ত গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব যানবাহনের বিকল্প হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো টেকসই ও আধুনিক যানবাহনের সূচনা যেমন হয়নি, তেমনি এগুলোকে প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপদ করা এবং এর চালকদের স্বল্পমেয়াদী কারিগরি ও মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণের কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার নির্মাণ এবং স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণ ব্যয়সাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে দেশে সংকট রয়েছে।  

এই হলো দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার নাজুক চিত্র। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা দানা বেঁধেছিল তা ফিকে হয়ে গেছে। প্রত্যাশা ছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় বিবেক জাগ্রত হবে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ কঠোর হবে। ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকসহ গণপরিবহন মালিকরা দায়িত্বশীল হবেন, চালক-শ্রমিকরা সচেতন হবেন। সড়ক ব্যবহারকারী ছাত্র-যুবসহ সর্বসাধারণও সচেতন হবেন। দেশে একটি টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণীত হবে এবং আইন-কানুন ও নীতি-নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হবার মধ্য দিয়ে সড়কে লাশের মিছিল ক্রমেই ছোট হবে। যানবাহনের চাকায় মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বুকফাটা আর্তনাদ ও হাহাকার বন্ধ হবে। কিন্তু কিছুই হলো না, বরং ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। তাই প্রশ্ন জাগছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
ই-মেইল: [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।