ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মধুমতির ফিরে আসা

সেলিনা হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২২ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
মধুমতির ফিরে আসা

পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসার দিনটি মুজিবের জীবনের সম্ভারে সুগভীর সঞ্চয়। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতায় জীবনের দিন কেটেছে, তার কোনো কিছুই বিলুপ্ত হয়নি।

স্মৃতির ঘরে সঞ্চিত হয়ে আছে। পাকিস্তানের জেলখানা ছিল এই সঞ্চয়ের আর একটি দিক। তিনি নিজেও ভেবেছেন কবে একদিন এখান থেকে ফেরা হবে বাংলার মাটিতে। বাংলার মাটি তাঁর মাটি, এই ভাবনা অনবরত তাঁকে স্থির রাখে। গভীর স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে এই ভাবনা থেকে। কারণ আর কোনো মাটির সঙ্গে মুজিবের নাড়ির টান নেই। এটা তাঁর বেঁচে থাকার মৌলিক শর্ত।  

সেদিন বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাড়িতে আসা হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের দাবিতে রেসকোর্স ময়দানে যেতে হয়েছে। রমনা রেসকোর্সে বক্তৃতা দিয়ে লাখ লাখ মানুষের চোখের কোনা ভিজিয়ে বেরিয়ে এসেছেন ভালোবাসার সুগন্ধি বুকে নিয়ে। এতো মানুষের ভালোবাসা তাঁকে জীবনের এই বয়স পর্যন্ত আপ্লুত করে রেখেছে। বাংলার মাটিতে ধ্বনিত হয় তাঁর প্রাণপ্রিয় গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। দেশের মানুষকে নতুন করে বোঝা হলো তার। মানুষের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাহসী চেতনার জন্য স্যালুট করে নেমে এলেন মঞ্চ থেকে। চারদিক থেকে ফুল আর ফুলের মালায় ভরে যায় শরীর। যতটা সম্ভব দু’হাতে জড়িয়ে রাখেন। ফুলের মাঝে ভেসে ওঠে রেণুর মুখ। এই সব ফুল আজ তার সামনে রেণুর ভালোবাসার দৃষ্টি। ওর দৃষ্টিতে লেগে থাকে ফুলের সুষমা। মুখে বলে, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখা জীবনের মানুষ তুমি। তুমি আমার মধুমতি, সেইসঙ্গে হাজার রকমের ফুল। তুমি আমার রঙ আর সুবাসের জীবন।  

- মুজিব ভাই গাড়িতে ওঠেন। অনেকে একসঙ্গে কথা বলে।

শত শত ফুলের মালায় শরীরে জড়িয়ে তিনি ফিরে আসেন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়িতে। দীর্ঘ নয় মাস এই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন মুজিব। মনে হয় এ বাড়ি আজ তার সামনে এক নতুন ভুবন।  

তাঁর সঙ্গে আসা রাজনৈতিক কর্মীদের অনেকেই বলে, আমরা এখন যাই মুজিব ভাই। আপনি এখন বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিন।  

- হ্যাঁ, সবাই ঘরে যাও। তোমরা সুস্থ থাক, ভালো থাক। কালকে আবার দেখা হবে।  
মুজিব সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়েন। অল্পক্ষণে রাস্তা খালি হয়ে যায়। লেকের ওপর থেকে স্নিগ্ধ বাতাস উড়ে আসে। বুকভরে শ্বাস টানেন তিনি। মাকে পেছনে রেখে পাঁচ ছেলেমেয়ে এগিয়ে আসে। সবার দিকে তাকিয়ে বুক উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। রাসেলকে কোলে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাসিনা, রেহানা, কামাল, জামাল তাঁকে ঘিরে ধরে।

- আব্বু, আব্বু আপনি কেমন আছেন?

- ভালো আছি রে সোনা-মানিকরা। তোরা কেমন আছিস? 

- ওদের কাছ থেকে উত্তর না শুনে আবার বলেন, ভালো আছিরে। তোদেরকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেছি।

তিনি গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। দেখতে পান রেণু ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কোল থেকে রাসেলকে নিচে নামিয়ে দেন। হাসিনা সবাইকে বলে, চল আমরা উপরে যাই। আব্বার জন্য নাস্তা রেডি করি। লাফাতে লাফাতে সবাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। বলতে থাকে, আব্বু এসেছে, আব্বু এসেছে। জয় হোক আব্বুর, জয় হোক আব্বুর। আব্বুর জয় হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে।  

হাততালি দিতে দিতে ওরা উপরে উঠে যায়।

প্রিয়তমা রেণু অপূর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। বলতে চান হৃদয়ের কথা। কিন্তু বলা হয় না। দৃষ্টির আভার বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে রাখেন চারদিকে। মুজিব জানেন এই তাকিয়ে থাকা তাঁর ভালোবাসার গভীর প্রকাশ। জয় করে নেয় হৃদয়ের সবটুকু। বর্ষার পলিমাটি যেভাবে উর্বর হয়ে উঠে ফসলের প্রাচুর্যে ভরিয়ে দেয় প্রান্তর, তেমন সবুজ প্রাণময় উচ্ছ্বাস হৃদয়ের মাঠভরা ফসলের সম্ভার। জীবনের সবটুকু ভরে রাখে ভালোবাসার ফসল। আশ্চর্য রেণুর দৃষ্টি। কৈশোর থেকে তিনি এই দৃষ্টি দেখেছেন। নয় মাস পরে জেলখানা থেকে ফিরে এসে মুজিব বুক ভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে হাত রাখেন রেণুর কপালে, যেন বাংলার প্রান্তর ওই কপাল, ওখানে রাজনীতির সবটুকু অর্জন জমাট হয়ে ফসলের মাঠ হয়ে আছে। এই মাঠ এভাবে সবাই পায় না। মুজিবের পাওয়া ভিন্নতর ব্যতিক্রমী সম্ভার। রেণু তাঁর শুধু জীবনসঙ্গী নন, তিন বছর বয়স থেকে রেণু তাঁর রাজনীতির সচলতার প্রিয়তম সঙ্গী। এমন একজন অপরূপ সঙ্গী জীবন জিজ্ঞাসার সবটুকু মণিমাণিকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। রেণুকে কোনোভাবেই এখান থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। রেণু তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো মণিমাণিকের একত্র সমাহার।  

রেণু বলে, চলো ঘরে যাই। ছেলেমেয়েরা সব উপরে গেছে। ওরাতো আজকে মহা খুশি যে বাবা ফিরে এসেছে।  

- তাতো হবেই। তুমিও হয়েছ। তোমার ভালোবাসার মধুমতি নদী ফিরে এসেছে তোমার বুকে। এছাড়াও তোমার ভেতরে সবুজ প্রকৃতি, ফসলের ক্ষেত সবকিছু আছে। পাখ-পাখালির কূজনে তুমি আমার গান মায়াবতী রেণু।  

- আর তুমি আমার মধুমতি নদী। তোমার মাঝে সাঁতার কেটে আমি নিজেকে ভরিয়ে রাখি। তোমার জলে ডুবে গিয়ে আমার সব আশা-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হতে দেখি। আমার কোনো কষ্ট নাই। তোমার জেলখানায় থাকার দিনগুলোও আমাকে মধুমতি নদীতে ডুবিয়ে রাখে। এজন্য তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পার না। মধুমতির পানি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। সেজন্য ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি তোমার দু’হাত মধুমতি নদী। আমার মন খারাপ হলে তা ধরে রাখি না ভেসে যায় নদীর স্রোতে। তোমাকে দেখতে পাই ঘরের সবখানে। তুমি আমার প্রাণের মধুমতি। তুমি দেশের জন্য যা কিছু কর তা আমি নিজের ভেতর সতেজ করে রাখি। এইসব ভাবনার মাঝে আমার দিন ফুরোয় না। একজন মানুষ দেশ নিয়ে এতকিছু ভাবতে পারে তুমি ছাড়া আর কাউকেতো এমন করে দেখি না।  

মুজিব হাসতে হাসতে বলে, চলো উপরে যাই। ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে। ওরা ভাববে বাবা-মায়ের কি হলো।  

- বাবা-মা প্রেমের কথা বলছে। ওরা যা ভাবে ভাবুক। ওদের ভাবনায় আমাদের জীবন ধন্য হবে।  

সিঁড়ির উপর থেকে হাসিনা ডাকে, মা খাবার রেডি করেছি। উপরে আসুন।  

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে। মুজিব রেণুর হাত ধরে। রেণুর মনে হয় ভালোবাসার মধুমতি ওকে জড়িয়ে রেখেছে। যেখানেই থাকুক দুজনের ভালোবাসার অদৃশ্য মায়াজাল দুজনকে পূর্ণ চাঁদের উজ্জ্বল জ্যোৎ¯œায় ছায়ার মতো স্নিগ্ধ রাখে।  

দোতলায় উঠে মুজিব বাথরুমে যায়। দেশের পানিতে স্নান করে নিজের পুরো শরীরের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি এখন বুড়িগঙ্গা নদী। পানি গড়াচ্ছে শরীর বেয়ে। আহ, কি শান্তি! বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে রেণু বলে, তোমাকে তোমার মাটিতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তুমি ধুয়ে ফেলেছ পাকিস্তানের জেলখানার সবকিছু। বাংলার মাটি তোমার মাটি- তোমার শরীর সেটাই দেখাচ্ছে। তুমি যেখানে ছিলে অনায়াসে তা ঝেড়ে ফেলেছ।  

ছেলেমেয়েরা মায়ের কথা শুনে হাসতে থাকে। হাসিনা বলে, তুমি কিছু খেয়ে নাও আব্বু। তারপরে রেস্ট করতে যাও।  

- হ্যাঁ, দে মা।  

- ডাইনিং টেবিলে দিয়েছি। তুমি আর মা খাও। আমরা নিচে যাই আব্বু। লেকের পাড়ে হেঁটে আসি।  

মুজিব কিছু বলার আগেই ছেলেমেয়েরা চলে যায়। ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। হাসিনার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, আব্বু এসেছে আমাদের বাড়িতে আনন্দের জোয়ার এসেছে। লেকের উপর থেকে বাতাস ভেসে আসছে।

রেণু বলে, ওরা আমাদেরকে একা থাকার সুযোগ দিল।  

মুজিব হাসতে হাসতে বলে, এসবই ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা। তোমাকে ওরা ভিন্ন চোখে দেখে। তুমি যে আমার জন্য কত কষ্ট সহ্য কর, এটা ওরা বোঝে। এ বোঝায় ওরা জীবন সার্থক করে।

রেণু নিজেও হাসতে হাসতে বলে, তোমার জন্য আমার কোনো কষ্ট নেই। তুমি আমার জীবনের সবটুকু ধরে আছ। স্বাধীন দেশে তুমি ফিরে এলে এর চেয়ে কোনো বড় গর্ব কি আমার হতে পারে! 

রেণুর ঝকঝকে দৃষ্টিতে অভিভূত হয় মুজিব। হাসতে হাসতে বলে, তোমার ভালোবাসায় ডুবে থেকে আমি দেশের জন্য কাজ করতে পেরেছি। দুঃখী মানুষদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছি। সবখানে তুমি আমার পাশে ছিলে রেণু। যে ঘর-সংসার আমি দেখতে পারিনি তুমি তা দেখে আমার পথকে মসৃণ করে দিয়েছ। তোমার কাছ থেকে আমি কোনো বাধা পাইনি। কোনো কষ্ট পাইনি।  

মুজিব উঠে দাঁড়ায়। রেণুও দাঁড়িয়ে বলে, আমার ভালোবাসা- ভালোবাসা বাংলা দেশের স্বাধীনতা। মুজিব প্রখর দৃষ্টিতে রেণুকে দেখে। রেণু মুজিবের বুকে মাথা ঠেকায়। দু’জনের শৈশব থেকে শুরু হওয়া একত্র জীবনের সবটুকু দু’জনের প্রখর অনুভবের স্বপ্নছায়া হয়ে ভরে আছে। দু’জনের ভালোবাসা বয়ে যায় অনন্ত সময়ের পথে। দু’হাতে রেণুকে জড়িয়ে রাখে মুজিব। ঘরের ভেতর বয়ে যায় ভালোবাসার মধুমতি নদী।

লেখক: প্রখ্যাত কথাসাহিত্যক
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।