ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আবারও এফএটিএফ-এর গ্রে-লিস্টে পাকিস্তান

আজিমুল হক, অতিথি লেখক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২১
আবারও এফএটিএফ-এর গ্রে-লিস্টে পাকিস্তান

ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-এর জুন ২০২১ সালের অধিবেশনে পাকিস্তানকে তাদের ধূসর তালিকাতেই (গ্রে লিস্ট) রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এফএটিএফ প্রেসিডেন্ট ড. মার্কাস প্লেয়ার চার দিনের ভার্চ্যুয়াল প্লেনারি বৈঠকের ফলাফল নিয়ে প্যারিস থেকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই ঘোষণা দিয়েছেন।

বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করার জন্য আমাদের আগে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নিয়ে জানা প্রয়োজন।

ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)- এর কাজ কী এবং এর ডোমেইন কী কী। মূলত মানি লন্ডারিং মোকাবিলার লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরির জন্য ১৯৮৯ সালে জি৭ এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)। এটি একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা। ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পরে ‘সন্ত্রাসে অর্থায়ন’ (Terrorism Financing) বিষয়টি এর ম্যান্ডেটে অন্তর্ভুক্ত করে কার্যপরিধি সম্প্রসারিত করা হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত এফএটিএফের সদস্য দেশ ৩৭টি; ইন্দোনেশিয়া এর পর্যবেক্ষক দেশ এবং একাধিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এর সহযোগী সদস্য যার মধ্যে জাতিসংঘ উল্লেখযোগ্য।

এফএটিএফের উদ্দেশ্য হলো মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার সুস্পষ্টতা সম্পর্কিত অন্যান্য হুমকি মোকাবিলার জন্য আইনী ও কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মানদণ্ড তৈরি করা। এফএটিএফ একটি নীতি নির্ধারণী সংস্থা যা একটি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সংস্কার আনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরিতে কাজ করে। এফএটিএফ সদস্য দেশগুলোর পিয়ার রিভিউ (পারস্পরিক মূল্যায়ন) এর মাধ্যমে তার সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করে। ২০০০ সাল থেকে এফএটিএফ বিশ্বের সবগুলো দেশের অর্থনৈতিক মানদণ্ডগুলো পর্যালোচনা করে কিছু কিছু দেশকে এফএটিএফ ব্ল্যাক লিস্ট এবং এফএটিএফ গ্রে লিস্ট নামে দুটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সদস্য মাত্র ৩৭টি দেশ হলেও এর গুরুত্ব অধিকতর হবার কারণ হলো, যদি কোনো দেশকে এফএটিএফ গ্রে অথবা ব্ল্যাক লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে তবে জাতিসংঘ অন্যান্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোকে সে দেশে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

যদি কোনো দেশের অভ্যন্তরে এফএটিএফ মানি লন্ডারিং বা টেরর ফাইন্যান্সিং এর প্রমাণ পায় তবে সে দেশকে গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ৪০টি সুপারিশ দিয়ে সেগুলোর ওপর কাজ করার নির্দেশ দেয়। দেশটি যদি এ ৪০টি সুপারিশ ঠিকঠাক পালন করতে পারে তবে গ্রে লিস্ট থেকে তার নাম উঠিয়ে নেওয়া হয় (বা হোয়াইট লিস্টেড করে বলা যেতে পারে)। সুপারিশগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিপূর্ণ না করতে পারলে সে দেশকে এফএটিএফ ব্ল্যাক লিস্টেড করে ফেলে। এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়া ও ইরান এফএটিএফ ব্ল্যাক লিস্টে রয়েছে।

পাকিস্তান কেন এফএটিএফ গ্রে লিস্টে?
পাকিস্তান এ যাবৎ দুই বার গ্রে লিস্টের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১২ সালে প্রথমবার এবং ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার। ২০১২ সালে গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হবার কারণগুলোর একটি হলো- ২০১১ সালে মার্কিন সরকার কর্তৃক পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি ওসামা বিন লাদেনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। এ ঘটনা পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সাথে দেশটির সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়ে। আরেকটি কারণ হলো, পাকিস্তানের ২০১২ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দুটি রেজুলেশনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ও স্বাক্ষর প্রদানে বিরত থাকা। রেজুলেশনগুলো ছিল ১২৬৭ ও ১৩৭৩, যাতে বলা ছিল কোন দেশ তাদের সীমানার অভ্যন্তরে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই সমর্থন করবে না, তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সম্মতি প্রদান করবে না এবং তাদের সকল সম্পত্তি জব্দ করবে। এই দুটি রেজুলেশন পরিপালনে ব্যর্থ হলে সে দেশকে গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ ছিল জাতিসংঘের। সে সময়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তেহরিক-ই-তালিবান, লস্করে তাইয়্যেবা, জামাতে দাওয়া ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠনগুলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে খুল্লামখুল্লা কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এসব কারণে গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত পাকিস্তান ৩ বছরে ৪০টি সুপারিশের ওপর কাজ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবিকপক্ষেই অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। ২০১৩ সালে পাকিস্তান তাদের Anti-terrorism Act সংশোধন করে। ২০১৪ সালে পাকিস্তান প্রথমবারের মতো National Internal Security Policy বাস্তবায়ন করে। এসব কারণে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এফএটিএফ পাকিস্তানকে গ্রে লিস্ট থেকে অপসারণ করা করে।

২০১৭ সালে লাহোর হাইকোর্টের এক রুলিং-এ বলা হয়, জামাতে দাওয়ার প্রধান হাফেজ সাইদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পর্যাপ্ত প্রমাণ পেশ করতে না পারার কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ ঘটনার ফলস্বরূপ, ২০১৮ সালে আবারও এফএএটিএফ পাকিস্তানকে গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে এফএটিএফ প্রাথমিকভাবে ২৭টি সুপারিশের ওপর পাকিস্তানকে কাজ করতে বলে। পাকিস্তানের মিডিয়াগুলোর দাবি, এর মাঝে পাকিস্তান ২৬টি সুপারিশ সম্পূর্ণরূপে পরিপালন করে ফেলেছে। এফএটিএফ অতিরিক্ত আরও ৬টি পয়েন্ট যোগ করে সেগুলোর ওপরও কাজ করতে বলেছে পাকিস্তানকে।

পাকিস্তানের করণীয়
এযাবৎকালে দেখা যায়, পাকিস্তান এফএটিএফ কর্তৃক সুপারিশকৃত ২৭টি পয়েন্ট ও অতিরিক্ত ৬টি পয়েন্টের ওপর আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এর পেছনে আমেরিকা ও ভারতের ভূমিকা রয়েছে। আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকা পাকিস্তানের কাছে সামরিক ঘাঁটি চায়। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, এ বছর জুন মাসে মার্কিন সরকার এফএটিএফকে পাকিস্তানকে গ্রে লিস্টেই রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে।

অপরদিকে, ভারতীয় মিডিয়া সর্বদাই জামাতে দাওয়া, ফালাহে ইনসানিয়াত, জয়সে মোহাম্মদ ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠনগুলোর ভারতে অপারেশনের পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে চলেছে। ভারত তার উপমহাদেশীয় ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার অস্ত্র হিসেবে সব সময়ই চাইবে পাকিস্তান যেন এফএটিএফ গ্রে লিস্টেই থাকে।

এসব দিক বিবেচনা করে পাকিস্তান যা যা করতে পারে তা হলো – 

প্রথমত, এফএটিএফ কর্তৃক সুপারিশকৃত ২৭+৬ টি পয়েন্টের বিপরীতে এ পর্যন্ত নেওয়া উদ্যোগগুলোকে মিডিয়ার সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারে। যেমন, ২০২০ সালে পাকিস্তান সরকার এন্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, এন্টি টেরোরিজম অ্যাক্ট এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল অ্যাক্ট সংশোধন করে যেগুলো এফএটিএফের সকল চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।  

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম অথোরিটি, পাকিস্তান সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ফেডারেল ব্যুরো অব রেভেনিউ ও স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান তাদের নিয়মিত প্রতিবেদনগুলোতে বৃহদাকার অগ্রগতিগুলো নিয়ে আলোচনা করে তা জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারে।

তৃতীয়ত, সরকার অর্থ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাগুলোকে স্বচ্ছতার সাথে কাজ করার সাথে সাথে সিটিজেন চার্টার প্রদান ও তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ভাবমূর্তি ইতিবাচক হবে।

চতুর্থত, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেসব দেশে মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ করা হচ্ছে সেসব দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং-এর বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতে পারে।

পঞ্চমত, পাকিস্তান Geo-Strategic Foreign Policy থেকে সরে এসে একটি Geo-Economic Foreign Policy দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক আন্তঃসম্পর্কের শক্তিশালী উন্নয়ন ঘটিয়ে নিজের একটি ইতিবাচক আন্তর্জাতিক রূপ ফিরিয়ে আনতে পারে। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, চীন (CPEC) এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম বিবেচনার তালিকায় থাকবে।

অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য এফএটিএফ গ্রে লিস্ট থেকে বের হতে হলে পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়ার সাথে সাথে অবশ্যই একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করতে হবে।  

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেন

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২১
নিউজ ডেস্ক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।