ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

একনজরে আফগানিস্তান

বিশ বছর স্থায়ী যুদ্ধ: কী ঘটেছিলো আর কী ঘটতে যাচ্ছে?

বিপ্লব রঞ্জন সাহা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০২১
বিশ বছর স্থায়ী যুদ্ধ: কী ঘটেছিলো আর কী ঘটতে যাচ্ছে?

১০২তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রক্কালে আফগানিস্তান এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটেছে এবং তালেবানরা ক্ষমতা দখল করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ড জো বাইডেন কর্তৃক সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরিভাবে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক মাসের ব‍্যবধানে, তালেবানরা অতি দ্রুততার সাথে তাদের দখলদারিত্ব সম্প্রসারিত করতে থাকে এবং রাজধানী কাবুলে ঢুকে পড়ে। অব‍্যবহিত পরেই আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ থেকে পালিয়ে গেলে, আফগান সরকারের পতন ঘটে এবং তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে নেয়।

গত সোমবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বক্তৃতায় আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত‍্যাহারের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে দাবি করেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে আফগান সরকারের পতন তার কল্পনার চেয়েও আগে ঘটে গেছে।

এখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে বিশ বছরে কী ঘটেছিলো তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে, ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে করা সন্ত্রাসী আক্রমনের পর থেকে সেখানে সংঘটিত বৈশিষ্টমণ্ডিত ঘটনাগুলোর একটি তালিকা উপস্থাপন করা হলো।

আফগানিস্তানে বিশ বছর স্থায়ী যুদ্ধ: কী ঘটেছিলো

জর্জ ডব্লিউ বুশ শাসনামল (২০০১ - ২০০৮)
১ সেপ্টেম্বর ২০০১: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা

১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১: ৯/১১ হামলার কারণে সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের যৌথ সিদ্ধান্তে বুশের স্বাক্ষর প্রদান ও আফগানিস্তানে ২৫০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন

৭ অক্টোবর ২০০১: তালেবান বাহিনীর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা শুরু করে

ডিসেম্বর ২০০১: আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, তালেবানের পতন এবং তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেনের পলায়ন

১৭ এপ্রিল ২০০২: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে পুনর্গঠনের আহ্বান

জানুয়ারি ২০০৪: আফগানিস্তানের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শাষিত সরকার ব‍্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি 

২৩ মে ২০০৫: মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এবং আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের মধ‍্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি স্বাক্ষর ও যৌথ ঘোষণা

নভেম্বর ২০০৬: ন্যাটো কর্তৃক ২০০৮ সালকে আফগান বাহিনীর হাতে সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ‍্য হিসেবে ঘোষণা

বারাক ওবামা শাসনামল (২০০৯ - ২০১৬)
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জোরদারকরণের অজুহাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে আরো সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা 

২৭ মার্চ ২০০৯: ওবামার পক্ষ থেকে আফগানিস্তানের সাফল‍্যের আলোকে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতাকে সম্পর্কিতকরণ

১ডিসেম্বর ২০০৯: ওবামার পক্ষ থেকে নতুন আরেকদল সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা

নভেম্বর ২০১০: ন্যাটোর পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের মধ‍্যে দেশীয় বাহিনীর হাতে জাতীয় নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব হস্তান্তরের সিদ্ধান্তে ঐকমত্য প্রকাশ

২০১০–২০১১: মার্কিন সৈন্যসংখ‍্যা ৯০ হাজারে উন্নীত

১ মে ২০১১: মার্কিন সামরিক বাহিনীর হাতে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের মৃত‍্যু

২২ জুন ২০১১: ২০১২ সালের গ্রীষ্মকালের মধ‍্যে আফগানিস্তান থেকে ৩৩ হাজার সেনা প্রত‍্যাহারের পরিকল্পনা গ্রহণ

ফেব্রুয়ারি ২০১২: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের মধ‍্যে সকল ধরনের আক্রমণের পরিসমাপ্তি ঘোষণা ও দেশীয় বাহিনীর হাতে জাতীয় নিরাপত্তা হস্তান্তর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীর ভূমিকায় ফিরে আসার পরিকল্পনা

২৭ মে ২০১৪: ওবামার পক্ষ থেকে ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ সম্পূর্ণ মার্কিন সেনা প্রত‍্যাহারের সময়সূচি ঘোষণা

ডোনাল্ড ট্রাম্প শাসনামল (২০১৭ -২০২০)
২১ আগস্ট ২০১৭: ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসীদের উত্থানে শূন‍্যস্থান পূরণ করতে খোলা-দুয়ার সামরিক অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০: মার্কিন সেনা সংখ‍্যা ব‍্যাপকভাবে কমিয়ে আনার পথ তৈরি করতে ট্রাম্প প্রশাসন ও তালেবানদের মধ‍্যে চুক্তি সই

১২ সেপ্টেম্বর ২০২০: প্রথমবারের মতো তালেবান প্রতিনিধি দল, আফগান সরকার ও সুশীল সমাজের একসাথে বৈঠক

১৭ নভেম্বর ২০২০: প্রথমে আধাআধি করণ ও পরে মধ‍্য জানুয়ারির ভেতরে মার্কিন সৈন‍্য সংখ‍্যা ২৫০০ জনে নামিয়ে আনার ঘোষণা

জো বাইডেন শাসনামল (২০২১ - চলমান)
১৪ এপ্রিল ২০২১: বাইডেনের পক্ষ থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ‍্যে সকল মার্কিন সেনা প্রত‍্যাহারের ঘোষণা

৮ জুলাই ২০২১: বাইডেনের পক্ষ থেকে সেনা প্রত‍্যাহারের সময়কাল ৩১ আগস্টে এগিয়ে আনা

১৫ আগস্ট ২০২১: আফগান সরকারের পতন ও তালেবানদের ক্ষমতা দখল

আফগানিস্তানে দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। মার্কিন নাগরিক ও তাদের সঙ্গে কাজ করা আফগানদের সরিয়ে নিতে কিছু মার্কিন সেনা এখনও কাবুলে আছে।  

এরইমধ্যে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে জোড়া বিস্ফোরণে ১৩ মার্কিন সেনাসহ নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। ইসলামিক স্টেট খোরাসান এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।

কিন্তু এরপর কী ঘটবে আর আফগান জনগণের ভাগ‍্যে কী লেখা আছে? চলুন তালেবানের বিষয়ে সারা বিশ্ব কী বলছে তা জেনে নেওয়া যাক।

চীন, ১৬ আগস্ট ২০২১
নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুইং বলেছেন, “আমরা আফগানিস্তানের জনগণের ইচ্ছা ও পছন্দকে সম্মান করি। চীন লক্ষ‍্য করেছে, আফগান তালেবানরা বলেছে, আফগানিস্তানে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে আর তাই তারা একটি খোলামেলা, ব‍্যাপকভিত্তিক ইসলামী সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলাপ আলোচনা শুরু করবে। আফগান জনগণ ও বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কর্মরত ব‍্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা বিধানে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। চীন আশা করে, তারা এই অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করবে যাতে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে দূরে রাখে এবং আফগান জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশ পুনর্গঠনকে নির্বিঘ্ন করা যায়। ”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮ আগস্ট ২০২১
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট-এর ওয়েন্ডি শেরম‍্যান বলেন, “তালেবান আফগানিস্তানে সরকার গঠনের আশা করছে। তারা বৈধতা চায়। আমরা তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সব কিছুই ব‍্যবহার করবো তাদের অঙ্গীকারে স্থির রাখতে। ”

ন্যাটো, ১৭ আগস্ট ২০২১
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ন্যাটোর জেনারেল সেক্রেটারি জেন স্টোল্টেনবার্গ-
“প্রথমত, আমার মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা দরকার তা হলো একটি বার্তা যে আমাদের দরকার একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা বদল, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আমাদের দরকার আফগানিস্তানে একটি ব‍্যাপকভিত্তিক সরকার যে মৌলিক মানবাধিকারকে সম্মান করবে। ”

যৌথ বিবৃতি, ১৫ আগস্ট ২০২১
আফগানিস্তানের ব‍্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইউকে, কানাডা-
“যারাই এখন আফগানিস্তান জুড়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব‍্য হলো জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং যথাশীঘ্র নিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ”

“আফগানিস্তানের জনগণের নিরাপদে এবং মর্যাদার সাথে জীবন যাপনের অধিকার আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ”

রাশিয়া, ১৮ আগস্ট ২০২১
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল‍্যাভরব ও কাজাখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখতার টলেবার্দির টেলিফোনে কথোপকথন-
তালিবানদের প্রাথমিক বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে আফগানিস্তান অভ‍্যন্তরীণ সমস্যার মধ‍্যে আছে,  সব রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ‍্যে আলাপ আলোচনার মাধ‍্যমে যা মীমাংসা করা যেতে পারে।

পাকিস্তান, ১৪ আগস্ট ২০২১
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বলেছেন:
“আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দাবি করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল আফগানিস্তান নিশ্চিত করতে দেশটি নেতাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। ”

ইউকে, ১৪ আগস্ট ২০২১
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলোচনাকালে-
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানকে একথা বলতে ঐক্যবদ্ধ যে সন্ত্রাস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। ”

এসব বক্তব্য ও বিবৃতির উৎস- চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ন্যাটো এবং মিডিয়া রিপোর্ট।

এই অঞ্চলের দেশসমূহ যেমন ইরান এবং তুরস্ক আফগান শরণার্থীদের ঢল নিয়ে মহাবিপাকে আছে, ইউরোপীয় সরকারগুলো চিন্তিত আফগানিস্তানে কর্মরত তাদের কর্মকর্তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব‍্যাপারে এবং আফগানরা জানে না শেষতক কী ঘটতে যাচ্ছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ।
ইমেইলঃ [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।