ঢাকা: গত ১১ এপ্র্রিল। পাকিস্তান থেকে ফিরছিলাম।
তবে শেষ পর্যন্ত আগ্রহের জবাব পেলাম লাগেজ সংগ্রহের সময়। তারাও আমাদের মতো সেখানেই আটকা পড়েছিল। গল্পে গল্পে যা জানলাম, তাতে চক্ষু চড়কগাছ! হবেই বা না কেন?
সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে মাত্র পাঁচ দিনের অনুশীলন! এরপরেই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া। ফলাফল রানার্স আপ। হাতে রুপার ট্রফি। এ অর্জন বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা খো খো দলের।
তবে শুধু মহিলা দলই নয়। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এশিয়ান খো খো প্রতিযোগিতায় একই ফলাফল অর্জন করেছে পুরুষ দলও।
উপস্থিত আমার অন্য একজন সহকারী এ গল্প শুনে বলে উঠলেন-চ্যাম্পিয়ন না হলেও আপনারাই তো নায়ক-নায়িকা। নামমাত্র সরকারী সেবা পেয়ে এশিয়ার পাঁচটি দলের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার, যা তা নয় বৈকি!
এ কথার সঙ্গে একমত হলেন খো খো জাতীয় দল দুটির কোচ আবদুল হাকিম মিয়া।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে জানালেন নানা বাধা-বিপত্তি পার করে বিদেশের মাটিতে খেলতে যাওয়ার কথা। বললেন, আজ কতটা সংগ্রাম করে তৃতীয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্স আপ বাংলাদেশ। অথচ প্রথম ও দ্বিতীয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাধারী ছিল বাংলাদেশ খো খো দল (পুরুষ)।
হতাশা ফুটে ওঠে খেলোয়াড়দের কণ্ঠেও। বিমানবন্দরে ভারতে থেকে খেলে আসা দল দুটির অনাড়ম্বর ফেরা দেখলেই বোঝা যায়, কতটা অবহেলিত এই দলটি। ছিনিয়ে আনা ট্রফি দুটি তখনও বিমানবন্দরের মাটিতে। সঙ্গী একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় হুইল চেয়ারে করে আনতে হয়েছে তাকে। অসুস্থ সঙ্গীকে নিয়ে ব্যস্ততার পাশাপাশি নিজেদের ব্যাগগুলো আসছে কিনা সে দিকেও চোখ রাখতে হচ্ছে প্রত্যেককে।
সেই ব্যস্ততার মাঝেই এ প্রতিবেদককে সময় দিলেন পুরুষ দলটির অধিনায়ক শেখ আবদুর রহমান রানা। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের এই ছাত্র বলেন, খো খো খেলার প্রচার কম। বাংলাদেশের অনেকেই খেলাটির সঙ্গে পরিচিত নয়। তবে স্বল্প পরিসরেও আমাদের অর্জন কম নয়। ২০০৭ সালে প্রথম ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে চ্যাম্পিয়ন হই আমরা, পরের বছরেও টানা দ্বিতীয়বার এ শিরোপা ধরে রাখি। তবে ২০১০ সালে তৃতীয় ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে আমরা রানার্স আপ হই। এরপর টানা পাঁচ বছর বাংলাদেশে বন্ধ থাকে খো খো খেলা। এজন্য মূলত ফেডারেশনের অদক্ষতা এবং অলিম্পিক থেকে কোনো সাড়া না আসাটাই দায়ী। ২০১৫ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসে আবারও এ খেলাটি যুক্ত হয়। সেখানেও আমরা রানার্স আপ ট্রফি জিততে সক্ষম হই।
গত ৭-১০ এপ্রিল ভারতের ইন্দোরে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এশিয়ান গেমসে রানার্স আপ দলের দলনেতা আক্ষেপ করে জানান, এটাও এক ধরনের খেলা। কিন্তু এ খেলায় আমরা স্পন্সর পাই না। স্পন্সর পেলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। আগামী বছর (২০১৭ সালে) খো খো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ভারতের উত্তর প্রদেশে। আমরা সেখানে খেলতে চাই। বিশ্বকাপে ভাল করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সে সুযোগ আমরা চাই।
রানা আরও বলেন, আমি পেশায় একজন ছাত্র। খেলার জন্য কোনো ভাতাও পাই না। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো খেলাটা চালিয়ে যাওয়া এক সময় কঠিন হয়ে যাবে।
পুরুষ দলের মতোই অর্জন ছিনিয়ে আনা খো খো মহিলা দলের অধিনায়ক ও যশোর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল অ্যাডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সাইন্স বিভাগের ছাত্রী ফাতিমাতুজ্জোহরা মুক্তা বাংলানিউজকে জানান, মাত্র পাঁচ দিনের অনুশীলনে দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, নেপালের মতো দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলে রানার্স আপ হয়েছি। বিশ্বাস করুন এটা অসাধ্য ছিল। সে অসাধ্যকে আমরা বাস্তবে পরিণত করেছি। চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে ভাল লাগতো। কিন্তু এটা ভারতের জাতীয় খেলা এবং ওরা খেলাটি নিয়মিতই চর্চা করে। যা করার সুযোগ আমরা পাই না।
মুক্তা জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খো খো খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে হবে। ভারত যেমন স্কুল পর্যায় বা অনূর্ধ্ব-১৪ বা ১৬ পর্যায় থেকেই জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় খুঁজে বের করে, বাংলাদেশকেও তেমন উদ্যোগী হতে হবে।
মুক্তার আরেক সতীর্থ সাতক্ষীরা সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্রী এগিয়ে এসে জানান, মেয়েদের খেলার ক্ষেত্রে এখনো কিছু সামাজিক বাধা আছেই। সেসব আমরা পার করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমাদের দলের বেশিরভাগ সদস্যই গরীব পরিবার থেকে উঠে এসেছে। একজন খেলোয়াড়ের যতটুকু পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন, বাড়িতে থাকলে সেটা পাওয়া হয়না। আবার আমরা কোনো ভাতাও পাই না। ২০০৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত খেলছি শুধুই খেলার প্রতি ভালবাসা থাকায়, দেশকে কিছু দিতে পারার আশায়। সেটাও খুব বেশি পারি না। কারণ, আমাদের প্রাকটিসের জন্য তেমন কোনো জায়গাও নেই।
এই দৈন্যতার কথা স্বীকার করে দল দুইটির কোচ আবদুল হাকিম মিয়াও জানান, যখন কোনো টুর্নামেন্টের চিঠি আসে, তখনই সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাছাই করা ছেলে-মেয়েগুলোকে ডেকে নিয়ে প্রাকটিস শুরু করি। তারা সবাই ছাত্র-ছাত্রী, কোনো ভাতা না পেয়েও খেলে যাচ্ছে। চাকরি ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের জন্য সরকার কোটা সংরক্ষণ করলে, খেলোয়াড়রা জীবন বাজি রেখে খেলবে, খেলার মানও বাড়বে। আন্তর্জাতিক একটা ইভেন্ট খেলে আসলেও চাকুরি বা ভাতার ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা এদেশের ক্রীড়াবিদরা পায় না। তাহলে তারা কেন খেলবে?
উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, আমাদের সঙ্গে খেলে ভারতের যে দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এক থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের কোটা ভিত্তিক চাকরি হয়ে যাবে। অথচ এই নিয়ম বাংলাদেশে নেই। কোন রকমে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের টাকা এবং কিছু স্পন্সরের সাহায্যে খেলার খরচ বহন করা হয় বলে জানান তিনি।
রানা-মুক্তাদের হাকিম স্যার যোগ করেন, সবশেষ সাউথ এশিয়ান গেমসেও আমরা রানার্স আপ হয়েছি। তখন প্রধানমন্ত্রী দলকে তিন লক্ষ টাকা দিয়েছেন। আর্থিক সহায়তা বলতে ওটাই। এছাড়া ট্রেনিংয়ের থাকা খাওয়া ও কিছু হাতখরচ দেওয়া হয়। আসে আনুসাঙ্গিক ট্রেণিং সামগ্রী। অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতো খো খো খেলোয়াড়দের প্রতিও সুদৃষ্টি দিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ভারতের মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে এশিয়ান খো খো চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় আসরে মহিলাদের ফাইনালে ভারতের কাছে ২৬-১৭ পয়েন্টে হারে বাংলাদেশ। একই ইভেন্টে ভারতের পুরুষ দলের কাছে ২৬-১৬ পয়েন্ট ব্যবধানে হেরে রানার্স আপ হয় বাংলাদেশ পুরুষ খো খো দল।
বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান ও কোরিয়া এই ছয় দেশ এবারের এশিয়ান খো খো চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
জেপি/এমআর