ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

কবিতা

প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | রুহুল মাহফুজ জয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১৭
প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | রুহুল মাহফুজ জয় ছবি: বাংলানিউজ

কবি রুহুল মাহফুজ জয়ের জন্ম ৩১ মার্চ ১৯৮৪, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি তিনি শিরিষের ডালপালার (শিল্প-সাহিত্যের ওয়েবজিন) সমন্বয়ক। 

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি রুহুল মাহফুজ জয়ের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।  


ভূগোল
পৃথিবী ভ্রমণের ইচ্ছা হলে আমি আম্মার মুখের দিকে তাকাই

দরিদ্র বেদনা সব কপালে জমে হয়েছে আফ্রিকা-এশিয়া
মুখের নিচের দিকে থুতনিতে দৃশ্যমান ল্যাটিন আমেরিকা
দুই গালে হাসির ভিতর লেপ্টে আছে আমেরিকা
                   ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়া

স্নো-ফল প্রসঙ্গে মায়ের চোখে শীতকাল এঁকে গেছেন বাবা
                  ইচ্ছেই তখন সুবিপুল সাইবেরিয়া

পৃথিবী ভ্রমণের ইচ্ছা হলেই আমি আম্মার মুখের দিকে তাকাই
                 দেখি, সমস্ত কাঁটাতার একেকটা বাবা
                 বাবার ফেলে যাওয়া মহাদেশ—অবজ্ঞা

ফটো
আব্বার লগে ক্যামেরায় তোলা একটাও ফটো নাই আমার
স্টুডিওর ভিতরে, পিকনিকে বা পারিবারিক সিরিমোনিতে
আব্বার লগে একবারও ফটো তুলতে দাঁড়াইতে পারি নাই
সেলফি-টেলফিও তুলি নাই কোনদিন
ফেইসবুকে দিমু- আব্বার লগে এমন ফটো আমার নাই
কলবের ভিতরে আব্বার একটা ফটো তুইলা রাখছি
চোখ বন্ধ কইরা সময়-অসময়ে ওই ফটোটা দেখি
আমারে ঘিরা কই থিকা জানি আদর নাইমা আসে
আমার বাপের লগে বিধিবৎ ফটো আজও তুলি নাই

মেঘৈতিহাসিক
পত্রীদা’র দেয়া বিয়েটা টেকেনি।

বজ্রকে উকিল নোটিশ দিয়ে মেঘ ফের পাহাড়ের কাছে। পাহাড় ততদিনে আর্তেমিসের কুমারীত্ব জিতে ‘নদী’ ও ‘ঝর্ণা’ নামের দুই কন্যার জনক। ‘মেঘ চিরকালই ভাসমান পতিতা’— বায়ুমণ্ডলে এমন লিফলেট বিলি করার দায়ে বজ্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে কেয়সের বউ। বোকা মেঘ জানে না, পাহাড় প্রকৃতির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নতুন কবিতা শুনতে সারারাত তার পায়ের কাছে পড়ে থাকে শিশির। সেসব কবিতার স্বাদ জুমধান, আদিবাসী বিষাদ। নীলগিরির রাত্রিতে পাহাড় ঘুমালে মেঘ বেবিটা উতলা হয়, পরিব্রাজক হাওয়াধ্বনির নিকট নিজেকে সঁপে দিতে দিতে শরমে মুখ লুকায়। মেঘেরা জন্ম থেকেই বাঙালি মেয়ে—সব পাহাড়ই জানে তা।

নির্বাণ
মৃত্যুর মতো হঠাৎ না বলে চলে আসব একদিন-একটা অপ্রস্তুত খরগোশ তোমার অধিস্থান থেকে মুখ তুলে তাকাবে; চোখের বয়সকে বলবে আগের সব দেখা ভুলে যাও, শেষ দৃশ্যে তুলে রাখো দীর্ঘ চুম্বন-আমি ঠিক মৃত্যুর মোহ নিয়ে তোমার ঠোঁটের কাছে এসে দাঁড়াব, বাতাসের গায়ে কম্পন তুলে তুলে চলে যাবে একটা ট্রেন…

নাইটমেয়ার ১৪
নিজের ছায়ার পিছে হাঁটতে হাঁটতে আলোটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো

সব অন্ধকার ঘুমালে চোখ মেলে তাকায় রাত
আর আমি আমার সঙ্গে দেখা করি
শূন্য হারেম- অপেরার সুর নেই পানশালায়
আমার ভেতর তবু বসত করে প্রাচীন মিশরের এক ফারাও —

নিজের ছায়া আমাকে দেখে হেসে ওঠে বাদশা আকবরের মতো

বিবাহিত সুখেরা অসুখ করলেই কেবল এ দরজায় আসে
ঘরময় তড়পায় কালো হাহাকার নিয়ে
আলোটার সাথে মাঝেমাঝে দেখা হয়ে যায়-ছুঁতে পারি না
বিরোধে পেরে উঠি না, নিজের ছায়াকে অসহ্য লাগে খুব —
যেমন আমার ছায়া সহ্য করতে পারে না আলোর মুখ!

 

কবিতার গল্প
ভূগোল কবিতাটির জন্ম আসলে আমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হয়েছে। কাগজে-কলমে লেখা হলো ৩২ বছর বয়সে। আমি যখনই আমার মায়ের মুখের দিকে তাকাই, মনে হয় ওটা একটা স্বতন্ত্র পৃথিবী। মায়ের কষ্টগুলো বলিরেখা হয়ে মহাদেশ-দেশ ভাগ হয়ে পৃথিবীর মানচিত্র গড়েছে। শুধু আমার মা কেন, পৃথিবীর তাবৎ মায়ের মুখমণ্ডলেই এরকম পৃথিবী থাকে। একেক সন্তানের কাছে সেই পৃথিবীর মানচিত্র বা ভূগোল একেক রকম। তবে তৃতীয় বিশ্বের মফস্বলী মধ্যবিত্ত মায়েদের চেহারায় যে ভূগোল, তা বোধ করি এক। এরকম ভাবনা থেকেই ‘ভূগোল’ কবিতাটির জন্ম।

বাবার সঙ্গে আমার দূরত্ব অনেক। যে দূরত্ব আসলে মাপা যায় না। প্রতি বছরই বাবা দিবস আসে। সন্তান হিসাবে আমি আমার বাবার পিতৃত্ব খুব মিস করি। বাবা দিবস এলে আরও বেশি মিস করি। সবাইকে দেখি বাবার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে। নানা কথা লিখে। স্মৃতিচারণ করে। বছর দুই আগে ফেইসবুকে পোস্ট করার জন্য ছবি খুঁজি। বাবার সঙ্গে আমার ছবি। একটাও ছবি খুঁজে পাইনি। স্মৃতি হাতড়ে মনে হলো, বাবার সঙ্গে আমার কখনও ছবি তোলা হয়নি। কিন্তু বাবার ছবি কি সত্যিই নেই? বাবা শব্দটা মনে এলেই তো তার ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। সেই ফটোটা তো কখনো মুছে যাওয়ার নয়। ক্যামেরায় না তুলতে পারা ছবির আক্ষেপ আর থাকেনি।

‘সেই গল্পটা’পূর্ণেন্দু পত্রীর জনপ্রিয় একটি কবিতা। এই কবিতায় কবি মেঘ আর পাহাড়ের ব্যর্থ প্রেমের কথা বলেছেন। মেঘকে বজ্রের সঙ্গে জোরজবরদস্তি বিয়ে দিয়েছেন। আমি প্রকৃতিতে জোরজবরদস্তির কিছুতে বিশ্বাস করি না। বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়ে কেন হতেই হবে! জোরের বিয়ে তো টেকে না। তাই আমি মেঘকে পাহাড়ের কাছে ফিরিয়ে এনেছি। কেননা, বজ্র হয়তো মেঘকে ভয়টয় দেখিয়ে পাহাড়ের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু পাহাড়ের কাছে মেঘ ফিরবেই। প্রেমিকের কাছে যেমন করে প্রেমিকা ফিরে আসে, যেভাবেই হোক। আর জোর করে মেঘকে বিয়ে করার কারণে বজ্রকে শাস্তিও দিয়েছি। প্রেমিকের কাছ থেকে প্রেমিকাকে যে আলাদা করে, তার শাস্তি প্রাপ্য। একজন কবি তো জোরজবরদস্তির বিয়ে সমর্থন করতে পারেন না!

যে প্রেমিকার কাছে মৃত্যুর মতো নীরবে চলে আসা যায়, সে হোক একপাক্ষিক প্রেম বা দ্বিপাক্ষিক- তা বিবেচ্য নয়। সেই প্রেমিকা এবং প্রেমের জন্যে নির্বাণ লেখা।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ যেকোনো মানুষকে ভাবতে শেখায়, সে-ই সেরা। সেই ভাবনায় অহম তৈরি হয়। অহম থেকে তৈরি হয় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, অস্থিরতা আর প্রলাপ। এই লেখাটি সেরকম প্রলাপ।

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ