আব্দুল মজিদ আপেল সাধারণ পরিবারের সন্তান। ২০০৮ সালের পর ক্ষমতার পালাবদলের পর আপেল বিএনপি ছেড়ে ঢুকে পড়েন আওয়ামী বলয়ে।
গত ১৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান শেষে আপেলের বিরুদ্ধে খুন, খুনে মদদ এবং দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায়।
নিজ স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
মান্নান হত্যাকাণ্ড: আপেল যুবলীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় ২০১৭ সালের ১১ জুলাই রাতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থ সম্পাদক মান্নান খুন হন। শহরের মুন্সিরহাট বিহারিপাড়া এলাকায় নৃশংস হামলার শিকার হন তিনি। মান্নানের পরিবারের অভিযোগ, আপেলের ক্যাডার যুবলীগ নেতা সজিব দত্ত, শান্তসহ চার থেকে সাতজনের একটি দল এই হামলা চালিয়েছিল।
মান্নানের স্বজনরা বলছে, মূলত ঠাকুরগাঁও অটোস্ট্যান্ডের টেন্ডার ও টোল আদায়কে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। মান্নান সদরের অটোস্টেশনের দরপত্রে অংশ নিলে আপেল যুবলীগ নেতা সজিব দত্তকে দিয়ে একাধিকবার মান্নানকে হুমকি দেন। এক পর্যায়ে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়।
স্বজনদের দাবি, যুবলীগ নেতা সজিব দত্ত ও মারুফ আলী শান্ত এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সজিব দত্ত তার বড় ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সমীর দত্ত ও যুবলীগ সভাপতি আপেলের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। সমীর দত্তের চাচতো ভাই সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি টিটো দত্ত। টিটো দত্তই আপেলের প্রধান খুঁটি।
‘বাবার মৃত্যুটা তো স্বাভাবিক হয়নি, তাকে খুন করা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। ’ বলছিল আব্দুল মান্নানের বড় মেয়ে ১৩ বছরের মাওয়া আক্তার। মান্নানের স্ত্রী জেসমিন আক্তার দুই মেয়ে মাওয়া (১৩) ও মাফিয়া (৮) আক্তারকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মাওয়া বলে, ‘বাবাকে হারিয়ে আমরা মাকেও হারিয়েছি। কারণ এখন মাকে কাজ করতে হয়। মা সকালে কাজে চলে যান। এ জন্য সারা দিন আমরা দুই বোন একা থাকি। বাবা বেঁচে থাকলে মাকে কাজ করতে হতো না। ’
পরিবারের সদস্যরা জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর মান্নানের স্ত্রীকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন; কিন্তু সেই চাকরি হয়নি।
স্বজনদের ভাষ্য, মান্নান সজিব দত্তের বড় ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্তকে নিজের নিরাপত্তার হুমকির কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
এই ঘটনায় সদর থানায় মামলা করেন মান্নানের বড় ভাই আবু আলী। স্বজনদের অভিযোগ, তারা মামলার এজাহারে আপেলের নাম দিলেও তা বাদ দিতে বাধ্য করে পুলিশ। পরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিব দত্ত (৩৫) ও পৌর যুবলীগের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক শান্তসহ (৩৬) অজ্ঞাতপরিচয় আরো চারজনকে আসামি করা হয়।
মান্নানের এক স্বজন বলেন, ‘আসামিরা জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা এত প্রভাবশালী যে তাদের ভয়ে কোনো উকিল আমাদের মামলা লড়তে রাজি হননি। ‘প্রভাবশালী কারা’—এমন প্রশ্নের জবাবে এই স্বজন বলেন, ‘একজনকে আমরা হারিয়েছি। এখন তাদের নাম বললে অন্যদেরও মেরে ফেলবেন। ’
স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু : মান্নান হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর আপেলের নিজ ঘরেই ঘটে আরেক নির্মমতা। স্বজনদের অভিযোগ, স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদের বলি হন হাসনাহেনা সুমি।
২০১৮ সালের ১০ আগস্ট স্বামীর বাড়িতে আগুনে দগ্ধ হন সুমি। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। ১২ দিনের মাথায় তার লড়াই শেষ হয়ে যায়। সুমির স্বজনদের দাবি, কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে আপেল ক্ষিপ্ত হয়ে সুমির শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল মজিদ আপেল বলেন, ‘এটি ছিল দুর্ঘটনা। আমি কেন তাকে হত্যা করব? এ অভিযোগ মিথ্যা। ’ তিনি দাবি করেন, ‘আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম। এখনো আমি ওর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি। প্রতি শুক্রবার ওর কবর জিয়ারত করি। ’
এই ঘটনায় মামলা করারও সাহস হয়নি জানিয়ে সুমির এক নিকটাত্মীয় বলেন, ‘আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু তার পরও মুখ খোলার সুযোগ নেই। ’
জমি দখলে বাধা দেওয়ায় হত্যা : ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর। সালন্দর ইউনিয়নের বরুণাগাঁও বগুড়াপাড়া গ্রামে জমি দখলে যায় আপেলের ক্যাডার হিসেবে এলাকায় পরিচিতি কয়েকজন। দখলে বাধা দেওয়ায় মারামারি বাধে। এতে গুরুতর আহত হন রাজু প্রমাণিকের ছেলে নূর মোহাম্মদ নুরু। ১২ নভেম্বর রাতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান নুরু।
সংঘর্ষের পরদিন ১১ নভেম্বর নুরুর ভগ্নিপতি ও জমির মালিক হানিফ ঠাকুরগাঁও সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় আজিজুর রহমান, রেজাউল করিম, বিলকু, নজরুল, জার্মান, সাদ্দাম, রিপন, নেন্দা বাওয়ের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এ ছাড়া আরো ১৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়।
নিহত নূর মোহাম্মদের ছেলে মিজানুর রহমান মজনু বলেন, সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা আবু দাইয়াম জনি এই ঘটনার শুরু থেকেই জড়িত; কিন্তু দলের চাপে পুলিশ তার নামে মামলা নেয়নি। পুলিশ বলেছে, জনির নাম বাদ দিলে মামলাটা ভালো হবে। না হলে সমস্যা হবে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনি স্থানীয়ভাবে আপেলের ডান হাত হিসেবে পরিচিত।
হামলার পরদিন নুরুর ভগ্নিপতি ও জমির মালিক মো. হানিফ ঠাকুরগাঁও সদর থানায় মামলা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ২৫-২৬ বছর আগে মফিজ মেম্বারের কাছ থেকে জমিটি কিনেছি। তারা আমার রান্নাঘরও পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখনো হত্যার বিচার পাইনি। হত্যাকারীরা এখন জামিনে রয়েছে। আমাদের ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। ’
হানিফ শেখের স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার গালে ও হাতে দা দিয়ে কোপ দিয়েছে। সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। ওখানেও মাইর দিতে আজিজুলের লোকজন রাত ১টা পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। ’
নম্র চৌধুরীর বাড়ি দখলের চেষ্টা : আপেল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুলতানুল ফেরদৌস নম্র চৌধুরীর বসতবাড়ি দখলের চেষ্টা করেন। এই ঘটনায় আদালতে আপেলের বিরুদ্ধে নম্র চৌধুরী মামলা করেন। নম্র চৌধুরী জানান, তার বাবা রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরী ছিলেন জাতীয় পার্টির মন্ত্রী। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের প্রধান সড়কের দক্ষিণ পাশে তাঁরা প্রায় শত বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন। ২০১৩ সালে একদিন আপেল সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে তার বাসায় হামলা চালান। হামলায় পরিবারের সদস্যরা আহত হয়। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ঘটনায় আদালতে আপেলের বিরুদ্ধে মামলা করি; কিন্তু আপেল এই মামলার বিপরীতে আমার বিরুদ্ধে উল্টো জমি দখলের অভিযোগ এনে মিথ্যা মামলা দেন। যেই মামলা দুটি এখনো চলমান। আমার বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আপেলের বাহিনী বাধা দেয়। মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি তো আছেই। ’
এ ছাড়া আপেল ঠাকুরগাঁও আউলিয়াপুর এলাকায় প্রায় ৪৫ একর আয়তনের শাসলা দিঘি দখল করেছেন। দখলে নিয়েছেন সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মানিক, ফারুক ডাক্তার, জহিরুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, মুন চৌধুরীসসহ অসংখ্য মানুষের জমি।
আউলিয়াপুর এলাকার এক গৃহিণী জানান, কয়েক মাস আগে আপেল কয়েক শ সন্ত্রাসী নিয়ে তাকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে আসেন। বাধা দিতে গেলে তার ছেলেটাতে ওরা বেধম পিটিয়ে জখম করে। এ বিষয়ে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিয়েও লাভ হয়নি।
একই জমির আরেক ওয়ারিশ একজন গৃহবধূ অভিযোগ করে জানান, ঘটনার সময় তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আপেলের ক্যাডাররা তাকেও পিটিয়ে জখম করলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অভিযোগ রয়েছে, একই এলাকার মান্নান হাজির ছেলে মাসুমের পল্লী বিদ্যুৎ টাওয়ার রাস্তাসংলগ্ন প্রায় দেড় বিঘা জমি আপেল জোর করে দখলে নিয়েছেন। বাধা দিতে গেলে তাদের মারধর করা হয় এবং মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। দেবীপুর এলাকায়ও ব্যক্তি মালিকানার প্রায় ৯ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছেন আপেল।
ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আপেল বেপরোয়া। তিনি কারো কথা শোনেন না। এলাকার ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বঞ্চিত করে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের পদ দিচ্ছেন। এ ছাড়া তার অন্যান্য কর্মকাণ্ডেও আমরা বিব্রত। ’
আপেলের বক্তব্য : যোগাযোগ করা হলে উপরোক্ত সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন আব্দুল মজিদ আপেল। তার ভাষ্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এসব রটাচ্ছে এবং তিনি হত্যাকাণ্ড ও জমি দখলের সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলেন না।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি এই থানায় পাঁচ মাস হলো দায়িত্বে আছি। এই সময়ে আপেলের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব। আমি আসার আগে এমন কিছু ঘটেছে কি না, সেটি আমার জানা নেই। ’
মান্নানের মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ঠাকুরগাঁও থানার তৎকালীন ইন্সপেক্টর মো. গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘আমি মামলার চার্জশিট দিয়ে এসেছিলাম। এই হত্যাকাণ্ডে আবদুল মজিদ আপেল ও দেবাশীষ দত্ত সমীরের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই তাদের মামলার আসামিতে রাখা হয়নি। ’
ঠাকুরগাঁও সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান টিটো দত্ত বলেন, ‘আপেল কোনো অপকর্ম করলে এর দায় তাকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগ তার অপকর্মের কোনো দায় নেবে না। ’
এ বিষয়ে কথা বলতে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীরকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি। পরিচয় জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠানোর পর একাধিকবার ফোন দিলে তিনি ফোন কেটে দেন।
আপেলের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঠাকুরগাঁও জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. সোহেল পারভেজ বলেন, ‘যুবলীগের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। এরপর আমাদের চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ’
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২২
এসআই