ঢাকা: সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে সরব বিএনপি। প্রতিটি কর্মসূচিতে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হলেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ কম।
ছাত্রদলের সিনিয়র নেতারা সঠিক কারণ খুঁজে বের করে, এর সমাধানের জন্য চেষ্টা না করলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটবে না। ফলে আগামীতে কঠোর আন্দোলনে সফলতা অর্জন করতে ছাত্রদল তেমন ভূমিকা পালন করতে পারবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপির নেতৃত্বে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয় ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে। চলমান এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে দলের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও ছাত্রদল। গত ২৭ জুলাই ঢাকার প্রবেশ পথে অবরোধ কর্মসূচিতে তেমন একটা সফলতা লাভ করতে পারেনি বিএনপি। সেদিন অবস্থান কর্মসূচির বেশির ভাগ পয়েন্টে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের তুলনায় ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল বেশি বিতর্কিত। ছাত্রদলের সিনিয়র এবং কেন্দ্রীয় বেশকিছু নেতার উপস্থিত না থাকার অভিযোগও উঠেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা শুরু হয়। এর মধ্যে ছাত্রদল সভাপতি (সাবেক) কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের অসুস্থতার কারণে দেখিয়ে সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে বিষয়টি আরও বড় আকারে সামনে আসে।
সহযোগী সংগঠন হিসেবে খ্যাত স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদলের যতটুকুই ভূমিকা ছিল, সে তুলনায় ছাত্রদলের ভূমিকা নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের কার্যকরী ভূমিকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই ভূমিকা ছাত্রদল পালন করতে পারছে না। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সক্রিয় তৎপরতার অভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে সেগুলো ততটা কার্যকর হচ্ছে না। ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পদ নিয়ে বিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল করে তুলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দল থেকে কঠোর নির্দেশনার পরও কর্মসূচিগুলোতে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগরের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি থাকে খুবই সামান্য। দলের নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে এসেই ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে ছবি তোলা ছাড়া তাদের তেমন একটা দেখা যায় না। ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদের নেতারা থাকলেও কর্মী ও সম্ভাব্য নেতারা উপস্থিত থাকেন না।
ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে পদ নিয়ে অসন্তোষের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। বিএনপির ক্রান্তিকালে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও যেসব তৃণমূল নেতারা দলের সঙ্গে ছিলেন, তারা থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটিগুলোতে কাঙ্ক্ষিত পদ পাচ্ছেন না। এই কারণে সরকার পতনের আন্দোলনে সমর্থন থাকলেও, দলের প্রতি চাপা ক্ষোভ থেকে আন্দোলনে তারা সর্বোচ্চটা দিচ্ছেন না। পাশাপাশি ছাত্রত্ব নেই এবং বিবাহিতদের পদ দেওয়ার অভিযোগও আছে ছাত্রদলের ভেতরে। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম মহানগর ছাতদলের সাংগঠনিক এসব দুর্বলতার কথা জানিয়েছেন ছাত্রদলের নেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের ওয়ার্ড পর্যায়ে পদপ্রত্যাশী এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, হামলা-মামলার শিকার নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করে না এমন ছেলেদের থানা ও ওয়ার্ডের সভাপতি-সম্পাদক করা হচ্ছে। আমি দীর্ঘ দশ বছর যাবত মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের ইউনিট পর্যায় থেকে রাজনীতি করে থানা লেভেলে এসেছি। কিন্তু খবর পেয়েছি আসছে থানা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ তিন থেকে চার বছর। এমনকি আগের কোনো কমিটিতে তার নাম ছিল না। দুঃসময়ে দীর্ঘদিন যাবত রাজনীতি করে এলেও আমাকে মূল্যায়ন করা হয়নি।
ছাত্রদলে ‘ভাই রাজনীতি’
ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ে কমিটি করার ক্ষেত্রে ‘ভাই রাজনীতিকে’ বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেসব পদপ্রত্যাশী ছাত্রদল নেতারা আছেন, তারা সাংগঠনিকভাবে তৎপরতা না বাড়িয়ে সিনিয়র নেতাদের পিছু নেন ভালো পদ পাওয়ার আশায়। পাশাপাশি সিনিয়র নেতারাও কমিটিগুলোতে প্রভাব রাখার জন্য নিজেদের লোকের জন্যই বেশির ভাগ সময় সুপারিশ করে থাকেন। ফলে কমিটিগুলোতে দীর্ঘদিন রাজনীতি করা এমন নেতাকর্মীরা পদবঞ্চিত হচ্ছেন। উলটো ভাইদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা ও অল্প কিছুদিন রাজনীতি করা কর্মীরা পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন সক্রিয় কর্মীরা।
নেতাকর্মীদের আর্থিক সংকট
কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের কম উপস্থিতির তৃতীয় কারণ আর্থিক সংকট বলে জানান ছাত্রদল নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপির লাগাতার কর্মসূচির ফলে অনেক নেতাকর্মী এর ব্যয়ভার বহন করতে পারছেন না। দল থেকে যে অর্থ দেওয়া হয়, তা সামান্য। সেটিও সুষ্ঠুভাবে বণ্টন হয় না। নিয়ম হচ্ছে, কোনো আন্দোলনে বা কর্মসূচিতে ইউনিট নেতাকর্মীদের দেখভাল করার দায়িত্ব ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের দেখভালের দায়িত্ব থাকে থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর। অভিযোগ আছে, থানা পর্যায়ের সিনিয়র নেতাকর্মীরা ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রোগ্রামের জন্য উলটো খরচ চান। অন্যদিকে আন্দোলন কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের খরচ এবং ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় যে ব্যয় হয়, তা বহন করা কষ্টকর হয়ে যায়।
কিছু কিছু ওয়ার্ডের কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, মহানগর দক্ষিণ ও পূর্ব ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মির্জা আব্বাস ও দলের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পান। কিন্তু উত্তর এবং পশ্চিমের নেতারা দল থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা পান না।
সম্প্রতি আন্দোলনে উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের ভূমিকা নিয়ে দলের মধ্যে প্রশংসা করা হলেও তৃণমূল লেভেলে ছাত্রদলের কমিটিগুলোতে আমিনুল হকের সমর্থকরাই বেশি বেশি পদ পাচ্ছেন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করা নেতাকর্মীরা পদবঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পশ্চিম ছাত্রদল নেতাদের। আমিনুল হকের আজ্ঞাবহ সংগঠনে পরিণত হয়েছে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল। আমিনুলের ব্যক্তিগত প্রটোকল ছাড়া পশ্চিম ছাত্রদলে পদ পাওয়া কঠিন বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রদলের বেশ কিছু পদপ্রত্যাশী নেতা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে আমিনুল হকের হোয়াটসঅ্যাপেও প্রশ্ন পাঠানো হয়। সেখানেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা ছাত্রদলের সাবেক একাধিক নেতা বাংলানিউজকে জানান, পদ নিয়ে বিরোধের কারণে আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ছে। আন্দোলনকে সফল করার জন্য ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পদ নিয়ে বিরোধের কারণে ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা যাচ্ছে না। এর ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ছে। ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পদ নিয়ে বিরোধ দূর করতে না পারলে আন্দোলনকে সফল করা কঠিন হবে। তাই তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি, ছাত্রদলের নেতৃত্বের উচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করা।
কমিটি নিয়ে তোপের মুখে নেতারা
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের থানা ও কলেজ শাখার কমিটি না হওয়ায় গত ২৭ মে রাতে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল।
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েলের নেতৃত্বে শতাধিক নেতাকর্মী তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় অবিলম্বে থানা ও কলেজ ইউনিট কমিটি গঠনের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বকুলের পথ অবরুদ্ধ করে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। এরপর কমিটি গঠনের আশ্বাস দিলে মহানগর উত্তর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কার্যালয় ছেড়ে যান।
পদ নিয়ে ছাত্রদলের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন সময় তারা বলছেন, ছাত্রদল বিএনপির ভিত্তিমূল। দলের যেকোনো আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পদ নিয়ে বিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল করে তুলছে।
তৃণমূল পর্যায়ের ছাত্রদলের সংকটগুলো নিয়ে কথা হয় বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমানের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের মধ্যেই আছে। নেতাকর্মীরা দলের কর্মসূচিগুলো পালন করছে। জেল-জুলুম খাটছে, অত্যাচারিত হচ্ছে; সবমিলিয়ে আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না নেতাকর্মীদের। কমিটির ক্ষেত্রে কোনো কোনো জায়গায় ছাত্রদল পুনর্গঠিত হচ্ছে। যেকারণে কোনো কোনো যায়গায় ছাত্রদল শক্তিশালী হচ্ছে। আবার নানা সমস্যার কারণে কোথাও হয়তোবা আগ্রহ হারাচ্ছে।
সেলিমা রহমান বলেন, আমার মনে হয়, এসব সমস্যা ঠিক করার জন্য ছাত্রদল চেষ্টা করছে, সামনে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। আর সংগঠন করতে গেলে নানা সময় নানা অভিযোগ ওঠে। সে সময় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তবে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে ঠিক হয়ে যাবে বলে আমি আশা করি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩
ইএসএস/এমজেএফ