ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

জনগণের শক্তি ব্যবহার করে সরকারকে হঠাতে হবে: বদরুদ্দীন উমর

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৪
জনগণের শক্তি ব্যবহার করে সরকারকে হঠাতে হবে: বদরুদ্দীন উমর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বর্তমান সরকার সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নির্বাচনের আগে পত্রিকাগুলোয় সরকারের যে কড়া সমালোচনা হতো, তা আর দেখা যায় না।

এই সরকারকে হঠাতে শক্তির প্রয়োগ ছাড়া উপায় নেই। এই শক্তি বাইরে থেকে নয় বরং জনগণের মধ্য দিয়ে দেশের ভেতর থেকেই আসতে হবে।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনায় সভায় এসব কথা বলেন লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর।

লেনিনের মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘লেনিন ও বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা: দেশে দেশে মুক্তির লড়াই’ শিরোনামে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক লেখক প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু। কবিতা আবৃত্তি করেন হাসান ফকরী।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, লেনিন একটি বিপ্লব করেছিলেন। আমরা যারা মার্কস, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি তারাও বিপ্লব কী তা জানি না। লেনিন বুঝেছিলেন, দেশ পাল্টাতে গেলে কাকে পাল্টানো দরকার। আমাদের দেশে হাসিনার মত ফ্যাসিস্ট ক্ষমতায় বসে আছে।

তিনি বলেন, ভারতে যে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণি ছিল, তারা অনেক লড়াই-সংগ্রাম করেছে। তবে এই সংগ্রামের রাজনৈতিক রূপায়ন ভারতবর্ষে হয়নি। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের কোনো চিন্তা করেনি। ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন, তেভাগা আন্দোলন—সবই অর্থনৈতিক আন্দোলন। সশস্ত্র সংগ্রামের কথা তারা চিন্তাই করত না। সে সময় চারু মজুমদার একমাত্র নেতা ছিলেন যিনি ক্ষমতা দখলের কথা বলেছেন। ক্ষমতা দখল না করে সমাজতান্ত্রিকরা নির্বাচনে প্রবেশ করল। কিন্তু এরকম একটি দেশে নির্বাচন দিয়ে কিছুই হয় না৷ একটি শক্তিকে সরাতে আরেকটি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।

তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাদের কারণে মানুষের সাথে সাথে পরিবেশও শেষ হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পুঁজিবাদের প্রভাবে বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নদী দূষিত হচ্ছে। পানি উপরিভাগ থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে। এত কোটি কোটি মানুষের কী হবে। সমস্যাটি এখানে অনেক বেশিভাবে দেখা দিচ্ছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দুনিয়ার লোক ছিল মাত্র ২০০ কোটি, তা বেড়ে আটশ কোটি হয়েছে। কয়েক বছর পর পনেরো-ষোলোশ কোটি হবে। মানুষ কোথায় যাবে? তারা খাবে কী? থাকবে কোথায়? কিছু কিছু চোর-ডাকাতরা বিদেশে নিজেদের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কয়েকবছর পর সেখানে তাদের নাতি-নাতনিরাও একই পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বিভিন্ন সংকটে তারা মারা পড়বে। এই অবস্থার মোকাবিলা একমাত্র সমাজতন্ত্র করতে পারে। পুঁজিবাদ শুধু শ্রমিকের শত্রু নয়, মানুষের শত্রু ।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা আজকে যাকে স্মরণ করছি, তিনি একশ বছর আগে পৃথিবী ছেড়েছেন। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যে বিপ্লব করেছেন সেটা তার নিজের দেশ থেকে অন্তরীণ হয়েছে। একই সমাজতান্ত্রিক যে বিপ্লব অন্য দেশেও হয়েছে তাও আজকে আর নেই৷ তবে লেনিন আছেন, তিনি থাকবেন।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সোভিয়েত পতনে বলেছিল, জোর করে দুর্বৃত্ত লেনিন ক্ষমতা দখল করেছিল, সেটি মুক্ত হয়েছে। দুর্বৃত্ত তারাই যারা লেনিনের রাষ্ট্র ভেঙেছে, আজকে পৃথিবীতে দুর্বৃত্তের শাসন চলছে। পুঁজিবাদ আজকে চরম ফ্যাসিবাদের আকার ধারণ করেছে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র আজকে চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। পৃথিবীজুড়ে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা নির্বাচিত হয়ে আসছে, ক্ষমতা দখল করছে। ইতালিতে মুসোলিনির পার্টি আবার এসেছে, আমেরিকায় যৌন নিপীড়নে শাস্তিপ্রাপ্ত ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা করে। তাই লেনিনের বিপ্লবের প্রয়োজন আজকে আরও বেশি করে আছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আজকে প্রশ্ন হচ্ছে সমস্ত সভ্যতা খাদের মধ্যে পড়বে নাকি সব সভ্যতা যান্ত্রিক হয়ে পড়বে। এটা বানানো নয়, বাস্তব সত্য। আজকে দেখতে পাচ্ছি, ব্যক্তিমালার পৃথিবী কোন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। পুঁজিবাদী সভ্যতা চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছে। কিন্তু মানুষ চরম দুর্গতির মধ্যে রয়েছে। এই করোনাভাইরাস ছিল পুঁজিবাদের দূত। এরকম মহামারি আবারও আসতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আজকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জয়ধ্বনির কথা শুনছি। সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলা হচ্ছে। এটা নাকি প্রাচুর্যে ভরে দেবে। শ্রমিক-পূঁজির দ্বন্দ্ব থাকবে না। তবে এর কারণে পৃথিবী যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। প্রাচুর্য আসবে তবে সেই প্রাচুর্য মানুষের কাছে পৌঁছবে না। পুঁজিবাদের হাতেই এটির মালিকানা থাকবে। মানুষ যন্ত্রের দাসে পরিণত হবে। লেনিন এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি ছিলেন বিপ্লবী। তার এই রুশ বিপ্লব ছিল সমস্ত পৃথিবী জন্য। সামাজিক বিপ্লব করতে হলে লেনিনকে আঁকড়ে ধরতে হবে।

মিডিয়া মানুষের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, লেনিন প্রচার মাধ্যমের শক্তি দেখেছিলেন তাই তিনি পত্রিকা বের করেছেন, এর মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদকে উন্মোচন করেছেন। আজকে মিডিয়া-প্রচার মাধ্যম সাধারণ মানুষের হাতে নেই। এটা মানুষের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। আজকে ওইরকম গণমাধ্যম আমরা পাব না। তাই আজকে আমাদের বিপ্লবের বাণী-চেতনা ছড়িয়ে দিতে সংস্কৃতির চর্চা প্রয়োজন। সংস্কৃতির মাধ্যমে বিপ্লবের চেতনা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারব।

তিনি বলেন, কিন্তু সংস্কৃতি চর্চা বাংলাদেশে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আজকে কোথাও সংস্কৃতির চর্চাই নেই। ডাকসুর সময়ে এখানে কত সংস্কৃতি চর্চা দেখেছি। বহু বছর পার হলেও আজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নেই। কারণ ক্ষমতাসীনরা সংস্কৃতি চর্চা চায় না। কাজেই সংস্কৃতির চর্চা প্রথম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, এটা হচ্ছে সমাজ বিপ্লবের সংস্কৃতি। নইলে সভ্যতা খাদের মধ্যে পড়বে।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, যতদিন সোভিয়েত টিকে ছিল ততদিন বিপ্লবের রাজনীতি ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির আলোচনা প্রশ্নাতীত ছিল। এখন বিপ্লবের রূপান্তরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নানা প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা নব্বইয়ের দশকের আগে ছিল না। বিপ্লবের রাজনীতি, মুক্তির রাজনীতি সমালোচনা-সংশয়ের সামনে আবার মহা সম্ভাবনারও সামনে। এগুলোর উপেক্ষা না করে এমন সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া অত্যাবশ্যক। এর মাধ্যমে চলার পথ ঠিক করতে হবে। লেনিনসহ রুশ বিপ্লবীরা যে অজানা পথ পাড়ি দিয়েছেন, আমাদের অবস্থা সেরকম নয়। আমরা চাইলে বিস্তৃতভাবে এ সংকট দেখে পথ নির্ধারণ করা সম্ভব।

আনু মুহাম্মদ বলেন, এখনও পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয় মানুষকে ধ্বংস করার জন্য। পুঁজিবাদ এখন এমন দিকে যাচ্ছে যেখানে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষাই মুশকিল হবে। চীনকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকানো, ভারতকে দিয়ে চীনকে ঠেকানো—এসব কোনো সমাধান নয়। বিশ্বব্যাপী জনগণের মাঝে মুক্তির লড়াই জাগ্রত করতে হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লেনিন সমাজতন্ত্রের যে বিপ্লব শুরু করেছেন, তা আজও শেষ হয়নি। বিপ্লব কোনো ইলেক্ট্রিক সুইচ নয়৷ যে একসময় অন্ধকার ছিল, সুইচ দেওয়ার সাথে সাথে আলো এসে পড়বে৷ এর একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছেদ করে নতুন রূপরেখা তৈরি করতে হবে এটা কেউ বোঝেনি। বর্তমান সরকার বলছে, উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। স্থিতিশীলতা বলতে সরকারের স্থায়িত্ব। এভাবে তারা গত পনেরো বছর ক্ষমতায় টিকে আছে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৪
এমজে

 
 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।