ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

শিবির নিষিদ্ধের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেন নির্যাতিতরা

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৪
শিবির নিষিদ্ধের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেন নির্যাতিতরা

ঢাকা: সন্ত্রাস দমন আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন শিবিরের হাতে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বাংলানিউজকে তারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানান।

তারা বলছেন, শিবিরের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গত ৪৭ বছরে সংগঠনটির হাতে নিহত হয়েছেন শতাধিক ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। তাদের হাতে আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ, এদের মধ্যে পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন শতাধিক।

নির্যাতিতদের দাবি, শিবিরকে আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ করলে এত প্রাণহানি হতো না। তারপরও নিষিদ্ধ হয়েছে, এটি অনেক ভালো সংবাদ।

ইসলামী ছাত্রশিবিরকে বিশ্বখ্যাত নিরাপত্তা বিষয়ক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস জেনস তাদের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে বলে জানা যায়।  

সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার পেছনে ছাত্রশিবিরের দায় ছিল, এমন অভিযোগ সামনে এনেই প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছর পর সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  

প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় শিবির ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে বলে জানা যায়। কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিলেন, তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেন।

২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হামলার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। নাট্যকর্মী হাবিবুর রহমান। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন এবং শিবিরের রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করে বিতাড়িত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এ অপরাধে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে মৃত ভেবে ফেলে রাখেন শিবির নেতাকর্মীরা। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাকে। এদের নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি ছিল। ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ হলে তারা আজ এসব করতে পারতো না।  

ইসলামী ছাত্রশিবির দেশব্যাপী নৃশংসতা চালালেও তাদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা।  

এরপর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী এবং জামায়াতের রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন।  

ছাত্র শিবিরের হাতে নির্যাতিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা অমিত কুমার বসু বাংলানিউজকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তচিন্তার জায়গা। কিন্তু ছাত্রশিবির সবসময় মৌলবাদী চিন্তা লালন করতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছে। এখন না করে আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ করলে দেশে এতো প্রাণহানি-ধ্বংস হতো না। চট্টগ্রামে শিবিরের হাতে ব্রাশফায়ারে এইট মার্ডার থেকে শুরু করে বহু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করেছে, এরপর হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা করেছে। এদের মতো এতো নৃশংস আর কেউ নেই।  

২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের নৃশংস হামলায় ডান পা ও হাত কেটে ফেলা হয় ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগের আরেক নেতা টগর মোহাম্মদ সালেহকে (২২) কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে মৃত ভেবে ফেলে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

এ ঘটনায় স্মৃতিচারণ করে টগর বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তৎকালীন সভাপতি আশরাফুজ্জামান ইমনের নেতৃত্বে কসাই মহিফুল, শিবলী, রমজানসহ বহিরাগত ১৫-২০ জন মিলে আক্রমণ করে মৃত ভেবে ফেলে যায়। শিবিরকে আরও আগে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল।  

শিবিরের হাতে নির্যাতিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আখেরুজ্জামান তাকিম বলেন, জামায়াত-শিবির আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন তাদের নিষিদ্ধের পরে মৌলবাদের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এখন শিবিরের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভাঙতে হবে।

হামলার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার ওপরে মাত্র ২৭ সেকেন্ড হামলা চালানো হয়। কিন্তু আমাকে বাঁচতে ৫৬ দিন আইসিইউতে থাকতে হয়। নয়টি অপারেশন করতে হয়েছিল।  

তার হামলার পিছনেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তৎকালীন সভাপতি আশরাফুজ্জামান ইমন দায়ী ছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ছাত্র শিবির নিষিদ্ধের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী। শিবিরের হাতে এ সংগঠনের ১১ জন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- ডা. জামিল আকতার রতন, জুবায়ের চৌধুরী রিমু, দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য রূপম, ফারুকুজ্জামান ফারুক, বনি আমিন পান্না, শামীম আহমেদ, আতিকুল বারী, রাজু আহম্মেদ বাবলু, আইয়ুব হোসেন, মোহাম্মদ সেলিম ও আসলাম।

ছাত্রমৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক অদিতি আদ্রিতা সৃষ্টি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর জন্মলগ্ন থেকেই এ শহীদরা জামায়াত-শিবির তথা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে।

১৯৮৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রনেতা মনিরসহ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (জাসদ) তপন, জুয়েল, মুকিম, ইয়াসির আরাফাত পিটু ও জালাল নিহত হন।  

শিবির নিষিদ্ধের ঘটনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আহাম্মেদ বলেন, আমাদের সংগঠনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জেলা, মহানগর কমিটির অসংখ্য নেতা শিবিরের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সন্ত্রাসবাদী জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি ছাত্র জনতার দীর্ঘদিনের দাবি ও আন্দোলনের বিজয়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে শুধু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী কিংবা সংস্কৃতিকর্মীরাই নন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একাধিক নেতা।

১৯৮৯ সালের ২৬ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক হাবীবুর রহমান কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের ছেলে ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছা, ছাত্রদল নেতা ও জাসাস রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে কুপিয়ে হত্যা করেন শিবির নেতাকর্মীরা।  

তবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘটনায় সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এটি চলমান ছাত্র জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য অবৈধ সরকারের এজেন্ডা। সে এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

১৯৭১ সালের আগে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। পরে স্বাধীন দেশে নিষিদ্ধ হলে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলী।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২৪  
এনবি 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।