ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে ক্রিয়াশীল ৩৬টি ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। সভায় সব ছাত্র সংগঠন নিয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জোট’ গঠন, ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় শোক পালন না করাসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সোমবার (১২ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বানে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাম ও মধ্যমপন্থী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ একাধিক ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন অংশ নিয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয়ে বৈঠকটি রাত ১০টা পর্যন্ত চলে।
নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের বন্দোবস্ত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা প্রণয়নে গত ৭ আগস্ট লিয়াজোঁ কমিটি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঘোষণার পর প্রথম বৈঠক করেছে এই কমিটি।
লিয়াজোঁ কমিটির পক্ষে সমম্বয়ক মাহফুজ আবদুল্লাহ, নাসির আব্দুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম আদিব উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়কও বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত একটি বাম ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতা জানান, আলোচনার শুরুতে আন্দোলনের কৌশল ব্যাখ্যা করেন সমন্বয়করা। এতে আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য সব ছাত্রসংগঠনের অবদানকে স্বীকার করে নেওয়া হয়।
ওই নেতা আরও জানান, ছাত্রসমাজ এবং ছাত্রলীগ ছাড়া সকল ছাত্র সংগঠন মিলে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জোট’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই জোটে ফ্যাসিবাদ-স্বৈরাচারের অংশ হওয়ায় ১৯৯০ সালের ছাত্রসমাজ এবং ২০২৪ সালের ছাত্রলীগকে বাদ দেওয়া হবে। আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা যতদিন থাকবে, ততদিন এই জোটের কার্যক্রমও থাকবে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে প্ল্যাটফর্মটি কতদিন থাকবে, এই বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ন্যূনতম এক মাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সময় নির্ধারিত হয়নি। এই সময়ে দলীয় ব্যানারে আলাদা কোনো কর্মসূচি দেবে না ছাত্র সংগঠনগুলো।
‘একইসাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে কোনো ছাত্র ক্যাম্পাসে বা অন্য কোথাও কারো ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হুমকি কিংবা ট্যাগ-ব্লেইম দিতে পারবে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
নেতারা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মী বা নেতা ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়াও ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করার বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। উপস্থিত সকল ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ সব সিদ্ধান্তের সাথে লিখিতভাবে একমত পোষণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, এ বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এতে সংগঠনগুলো ভিন্ন ভিন্ন মত দেয়। ফলে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও আলোচনা করা হবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবির রাজনীতি করতে পারবে কি না, এ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। এতে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন মতামত দেয়—যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারা সবাই মিলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ ছাত্র শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। এখন আর তা কার্যকর নয় বলেও আলোচনায় উঠে আসে।
বৈঠকে উপস্থিত একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা বলেন, অনেকটা আকস্মিকভাবে দুপুরে আমাদের আলোচনার কথা জানানো হয়। এছাড়া খুব বেশি পরিচিত নয়, এমন অনেক ছাত্রসংগঠনও এ বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েছে। ফলে বৈঠকে গভীর মতামত দেওয়ার সুযোগ কম ছিল।
ছাত্র শিবিরের উপস্থিতি, দুই ছাত্র সংগঠনের বৈঠক বর্জন
লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে ১৭ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় হলো বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। মতবিনিময় সভায় শিবিরের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সাদ্দাম ও ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক আহনাফ আব্দুল্লাহ অংশ নেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদে নিষিদ্ধ জাতীয় ছাত্রসমাজ ও ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনসমূহ উপস্থিত থাকায় লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক বর্জন করেছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল। বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল।
তিনি বলেন, শুরুতে এই সভায় উপস্থিত কারা থাকবে এবং মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডার ব্যাপারে একধরনের অস্পষ্টতা ছিল। পরবর্তীতে আমরা নিশ্চিত হই এই সভায় জাতীয় ছাত্রসমাজ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ অনেক ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ উপস্থিত থাকবে।
জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এ সভায় সংগঠন দুটির উপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামের ইতিহাসের সাথেই বেমানান। একই সাথে তা ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সকল ক্রিয়াশীল সংগঠনের ঐক্যমতের বিরোধী— যা সংগ্রামের ইতিহাসকেই অস্বীকার করে। ফলে আমরা এ সভায় অংশ না হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবির, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (রাগিব নাঈম), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (মুক্তি কাউন্সিল), বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ইউপিডিএফ), বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (জেএসএস), বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ (নুর), বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ, ছাত্র আন্দোলন (এনডিএম), বিপ্লবী ছাত্রসংহতি, রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া), বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র মজলিস, গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র সমাজ, বাংলাদেশ ছাত্র মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রসমাজ, বাংলাদেশ ছাত্রমিশন ও বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, জুম লিটারেচার সোসাইটির প্রতিনিধিরা মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২৪
এমজেএফ