গাজীপুর: মৌসুমী নেতাদের হাতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ থাকায় অন্তঃসারশূন্য গাজীপুর বিএনপির ওপর ভরসা করতে সাহস পাচ্ছেন না দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
সে কারণে অনড় থাকলেও শেষ সময়ে জানতে পেরে ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরের আগমনকে ‘রাজনৈতিক দেওলিয়াপনা’-র অংশ হিসেবেই হরতালের ডাক দেন।
রোববার গাজীপুর বিএনপির বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গাজীপুর বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, অনেক দিন ধরেই কমিটি নেই। সম্মেলন হয় না।
তাদের আরো অভিযোগ, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক মিলন ও সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল দুইজনই মৌসুমী নেতা। তারা কেউ গাজীপুরে থাকেন না। জেলার দুটি শীর্ষ পদও পেয়েছেন বিনা কাউন্সিলে। সরাসরি ভোটে কাউন্সিল না হওয়ায় নেতাকর্মীরা মিলন ও বাবুলকে নেতা হিসেবে মানেন কিনা তাও যাচাই করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বাংলানিউজকে বলেছেন, ফজলুল হক মিলন বিএনপিকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করেন। তিনি বর্তমানে কালিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে তিনি গাজীপুর জেলা বিএনপিরও সভাপতি। আবার কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। মিলনের রাজনীতি মূলত ঢাকাভিত্তিক।
তিনি সব সময় খালেদা জিয়ার চারপাশে থাকতে পছন্দ করেন। তাই, গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ কম। কয়েকজন নেতার মাধ্যমে তৃণমূল নেতাকর্মীরা মিলনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ফলে, ফজলুল হক মিলনের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দূরত্ব অনেক বেশি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে এক নেতা বলেছেন, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ঢাকায় থাকেন। তিনি বছরে কয়েকবার গাজীপুরে আসেন। বড় কোনো কর্মসূচি হলে প্রধান অতিথির আসন নিশ্চিত করে তিনি গাজীপুর আসেন। প্রধান অতিথির আসন নিশ্চিত করা ছাড়া গাজীপুরে তার আগমন হয়েছে, এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারেননি সংক্ষুব্ধ ওই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলীয় আরেকটি সূত্র জানায়, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল মূলত একজন ব্যবসায়ী। রাজনীতিকে পুঁজি করে তিনি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেন।
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে কালিয়াকৈর পযন্ত অসংখ্য বিরোধপূর্ণ জায়গায় কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুলের নামে সাইনবোর্ড আছে। তিনি ওই সব জায়গা দখলে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে বিএনপির রাজনীতি করেন।
কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল জিয়াউর রহমানের আমলে সরকারি জমি বরাদ্দ নিয়ে কালিগঞ্জে ন্যাশনাল জুট মিল গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে তিনি ওই জুটমিল বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই অর্থের কারণেই তিনি গাজীপুর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।
সূত্র জানায়, কালিগঞ্জের ন্যাশনাল জুটমিল অবৈধভাবে বিক্রি হয়েছে। সরকারি জমি লিজ নিয়ে বিক্রি করা যায় না। তবুও তিনি বিক্রি করেছেন কৌশল খাটিয়ে। ওই জমির বিষয়ে সরকারি চাপ থেকে বাঁচার জন্য ও কালিয়াকৈরে বিরোধপূর্ণ জমিগুলো নিজের দখলে রাখতে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ। ফলে, কালিয়াকৈরের এমপি ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুলের দহরম-মহরম সম্পর্ক।
মন্ত্রীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা থেকেও রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল।
সম্প্রতি, যে সব মামলা হয়েছে, ওই সব মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও ফজলুল হক মিলন আসামি হলেও বেঁচে গেছেন কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সাধরণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদবীধারী নেতাদের অধিকাংশই গাজীপুর জেলা শহরের বাইরের বাসিন্দা। তাদের মধ্যেও আবার গাজীপুর জেলার সীমানা ছেড়ে ঢাকায় বাড়ি করেছেন তারা।
ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা গাজীপুরে আসলে গাড়ি বহরে গাজীপুরে প্রবেশ করেন গাজীপুর জেলা বিএনপির বড় পদে থাকা নেতারা। টিভি ক্যামেরায় বড় নেতাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে ফটোসেশন করে মিশে যান অদৃশ্যে!
সম্প্রতি, গাজীপুর জেলা ও মাহনগর ছাত্রদল কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। গাজীপুরে মানববন্ধন বিক্ষোভ মিছিল করতে করতে তারা ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়েও আন্দোলন করতে গেছেন।
তাদের দাবি ছিল, ২৭ ডিসেম্বরের আগেই গাজীপুর জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করার। ১২ বছর আগে করা ছাত্রদলের কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি করার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তারা। কিন্তু তা হয়নি।
এছাড়াও গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভা বিলুপ্ত হয়ে গাজীপুর মহানগর গঠিত হলেও হচ্ছে না কোনো কমিটি। এতে পদশূন্য হয়ে রয়েছেন অনেক সিনিয়র নেতা। ফলে, গাজীপুরে তারাও তেমনভাবে মাঠে নামেননি।
এদিকে, বিএনপির মূলদলেও রয়েছে কোন্দল। হাসান গ্রুপ আর মান্নান গ্রুপের কোন্দল তুঙ্গে। মূল দলে রয়েছে একাধিক কমিটি আর গ্রুপিং। জাতীয় ইস্যুতে হাসান ও মান্নান এক মঞ্চে বসলেও পরে আর এক সঙ্গে দেখা যায় না। মান্নান হাসান বিশেষ মুহূর্তে এক মঞ্চে আসলেও তাদের অনুসারীরা কোন্দল রেখেই দলীয় দায়সারা কাজ করেন।
দলীয় সূত্রের অভিযোগ, বিএনপির সহযোগী সংগঠনের প্রত্যেকটিতে দলীয় কোন্দল ও একাধিক কমিটি থাকায় গাজীপুর বিএনপি অন্তঃসারশূন্য। নেই তাদের চেইন অব কমান্ড। সহজে যোগাযোগও করা যায় না জেলার সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে। পুলিশের ধাওয়া খেলে সিনিয়র নেতাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, থাকে না কোনো নির্দেশনাও। ফলে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠে না।
দলীয় সূত্র বলছে, ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরের জনসভা থেকে খালেদা জিয়ার পিছুটানের পেছনে বড় কারণ ছিল গাজীপুর বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার ঘটনা।
প্রথম থেকে খালেদা জিয়া গাজীপুর বিএনপিকে সুসংগঠিত বলে মনে করলেও জনসভার আগে তিনি জানতে পারেন, গাজীপুর বিএনপি অন্তঃসারশূন্য। ফলে, গাজীপুরের জনসভা থেকে তিনি পিছু হটেন।
এ সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে রোববার বিকেল ৪টায় গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনকে ফোন করলে কেউ ফোনকল রিসিভ করেননি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় যায়। আরো অনেক দায়িত্বশীল নেতার ফোনে ফোন করলে অধিকাংশ নেতার ফোনই বন্ধ পাওয়া গেছে।
গাজীপুর জেলা বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন তালুকদার ফোন ধরলেও তিনি বাংলানিউজকে জানান, আমি পলাতক আছি। বড় নেতাদের ফোন বন্ধ। এই মুহূর্তে আমার বাসায় পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তাই, কিছু বলতে পারছি না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৪