হরতালকে আতংকের ‘ভয়তাল’ বানিয়ে ছেড়েছে বাংলাদেশের হঠকারি রাজনীতির কুশীলবরা। এখন নতুন আরেক আপদ জাতির ঘাড়ে চেপেছে।
হরতাল দিয়ে অবরোধ করে কি ফায়দা লুটতে চায় বিএনপি? আর এই অবরোধটাও তো বিএনপির কোনো কর্মসূচিই ছিল না! বিএনপিনেত্রী নিজের অবরুদ্ধ অবস্থায় সাংবাদিকদের পীড়াপীড়িতে যেই না মুখ ফসকে বলে ফেললেন ‘অবরোধ চলবে’, আর যায় কোথা! অবরোধহীন কর্মসূচিই হয়ে উঠলো অবরোধ কর্মসূচি। আর তা চলতেই থাকলো। সরকারের ওপর রাগ করে বিএনপি কেন ঝাল মেটাল জনগণের ওপর? জনগণ কেন বারবার নিরীহ মেষশাবক হয়ে অন্যের কাজের ফলভোগ করবে? বিএনপির রাজনীতির এই সমন্বয়হীনতা এই সময়ে এসে দলটির দিকভ্রান্ত, গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন চেহারাটাকেই প্রকট করে তুলেছে সবার কাছে। রাজনীতির মাঠে নিজেদের দেউলেপনা ঢাকতে জামায়াত-তোষণকারী এই দলটি এখন ক্ষ্যাপার মতো আচরণ করছে। ইজতেমার সময় অবরোধ শিথিল না করাটা এরই বড় প্রমাণ। পালহীন নৌকার মতোই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও গন্তব্যহীন রাজনীতির অথই সাগরে ভেসে চলা দল হয়ে উঠেছে এরা।
‘‘কী লাভ করলাম রে ভাই গাজীর গীত গাইয়া
পাঁচ সিকা লাভ করলাম দেড় টেকা খাইয়া’’
এই গানটা গাইতে শুনতাম গ্রামের কৃষকদের। গানের সরল কথাগুলো কিন্তু বড়ই তাৎপর্যময়! এখানে নিরক্ষর কৃষক হয়ে উঠেছেন দার্শনিক। তার উপলব্ধির তাৎপর্যকে হালকা করে দেখার যো নেই। কেননা গাজীর গীত গেয়ে করা আয়ের চেয়ে তার ব্যয় যে বেশি হয়ে গেছে তাতে তো ক্ষতিই হলো শেষমেষ। বিএনপিরও হয়েছে সেই দশা—পাঁচ সিকার আয় আর দেড় টাকা গচ্চা দিয়ে কি লাভ কুড়াচ্ছে বিএনপি?
অস্ত্রোপচারের ছুরি দিয়ে ডাক্তারেরা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার করে থাকেন। এখন যদি পেঁয়াজ কাটার কাজে, মাংস কাটা আর মাছ কুটার কাজে অবসিডিয়ান নাইফের বা শল্য ছুরি ব্যবহার শুরু করে দ্যায় কেউ, তাহলে? সেই ছুরি দিয়ে কি আর অস্ত্রোপচার করা যাবে? হরতাল আর অবরোধকেও অতি-ব্যবহারে ভোঁতা করে দিয়েছে বাংলাদেশের চলমান কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজনীতি। এক সময় হরতাল ডাকলে মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিতো। পাকিস্তান আমলে এবং তারও বহু পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের বহুদিন পরও সেটা দেখা গেছে। তখন হরতাল ডাকা হতো কিন্তু তা মানতে বাধ্য করা হতো না। বোমা, ককটেলে মানুষ পুড়িয়ে ভয় ও আতংক ছড়িয়ে হরতাল মানতে বাধ্য করা হতো না। সে-সময় রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য। আর এখন? রাজনীতি মানেই আতংক আর রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের চোখে মূর্তিমান দানব। যখন ইচ্ছে আজরাইলের মতো আপনার-আমার জান কবচ করার জন্য এরা বোমা, ককটেল, লাঠি, দা-কুড়াল নিয়ে আবির্ভূত হয়। কিছু বুঝবার আগেই আপনি আহত, রক্তাক্ত, দগ্ধ, মৃত অথবা অর্ধমৃত। কিন্তু ভয় দেখিয়ে তো পুলসিরাত পাড়ি দেওয়া যায় না!
আতংককে একমাত্র পুঁজি করে আর যা-ই হোক মানুষের মন জয় করা যায় না। গণতন্ত্রের নামে রক্তপাত, সহিংসতা করে গণতন্ত্র আনা যায় না; গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করা যায় না। অবসিডিয়ান নাইফ দিয়ে মাছ কুটলে, সবজি কুটার কাজ করলে যেমন পরে আর আসল কাজ করা যায় না, হরতাল-অবরোধের মতো অজনপ্রিয় টোল ব্যবহার করেও রাজনীতির বৈতরণী পাড়ি দেওয়া যায় না। কিন্তু যে দেউলে হয়ে গেছে, যে-দল ভূতের পায়ে উল্টো দিকে হাঁটছে গোঁয়ারের মতো, তার কি সে-হুঁশ আছে?
আজ বলতেই হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচে বেহুঁশ আর দিকভ্রান্ত দলটির নাম বিএনপি। এর এক কাঁধে জামায়াতের ভূত, হেফাজতের ভূত, যুদ্ধাপরাধীদের ভূত, জঙ্গিবাদ, পশ্চাদপদতা, মৌলবাদ, আর সুবিধাবাদ; এর অন্য কাঁধে নিজের ভুল সিদ্ধান্তের দীর্ঘ আমলনামা। কখনো এই দল মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের গায়ে আচড় বসায় তো, কখনো এর মহানায়ককে বানাতে চায় খলনায়ক। কিন্তু এভাবে সে অন্যের বুকের দিকে একের পর এক যে-বিষতীর ছুড়ছে, তা মূলত বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে তার নিজেরই বুকের দিকে। এক কথায়, বিএনপি আজ এক উদ্দেশ্যহীন ক্ষ্যাপাদের দলে পরিণত।
দেশকে অবরুদ্ধ করে রাখলে কোটি কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। শ্রমিক না খেয়ে থাকে। শ্রমিক চাকুরি হারায়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে লাল বাতি জ্বলে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা-পরীক্ষা-ক্লাশ সব শিকেয় ওঠে। মানুষ রাস্তাঘাটে বেঘোরে প্রাণ দেয়। তাতে কি বিএনপির কোনো লাভ, কিসের লাভ? ‘পাঁচ সিকে লাভ করে দেড় টেকা’ খরচ করে কপর্দকহীন হয়ে পড়ার লাভ? গত দশ বছরে বিএনপি দল হিসেবে কি ছিল আর কি হয়েছে---বিএনপির নেতা ও মন্ত্রণাদাতারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন?
মানুষকে ভয়ে-দুর্ভোগে-উদ্বেগে-আতংকে ডুবিয়ে, অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে, দিনমজুর-শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে, কারখানার চাকা বন্ধ করে চলছে হরতাল-অবরোধ নামের ছলনার পাশাখেলা। হরতাল-অবরোধকে বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র ললাটলিখন বানিয়ে বিএনপি যে নিজের ললাটকেই বলিরেখায় ভরে তুলেছে সেটা এর নেতারা কখন বুঝবেন?
এভাবে আর কতো? খালেদার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া এই অবরোধের পেছনে যুক্তি কি?
রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে সরকারই বা আর কতোকাল এইসব জুলুম-নৈরাজ্য নীরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখবে? আমরা চাই অবরোধ–হরতালের নামে এই অপরাজনীতির চির অবসান। এজন্য চাই আইন---কঠোর প্রয়োগযোগ্য আইন। আর দেরি করা নয়; এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত, সম্পদহারা, আহত ও নিহত মানুষ যাতে ক্ষতিপূরণ পান সে ব্যবস্থা যেন থাকে। যারা বা যেসব দল নৈরাজ্য করবে, মানুষকে বিপন্ন-আহত করবে, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণও দেবে দায়ী দল ও এর হঠকারি নেতারা। তাহলেই দেখা যাবে দলগুলো নিজেদের আচরণ পাল্টাতে শুরু করে দিয়েছে। নিজের লেজে পা না পড়লে কেউ তো আর সজাগ হয় না!
খুন করলে যেমন দায়মুক্তি দেওয়া চলে না, তেমনি হরতালে গাড়ি পোড়ালে, মানুষ পোড়ালে, সম্পদহানি করলেও যেন কোনো দল দায়মুক্তি না পায়। আইন একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য যেমন, একজন রাজনীতিকের জন্যও যেন হয় অনুরূপ। বিশেষ করে তার প্রয়োগের বেলায় যেন হয় সবার জন্য সমান। হরতাল-অবরোধের গ্যাঁড়াকল থেকে বের হয়ে আসাটাই হোক রাজনীতি-সংস্কারের প্রথম ধাপ। আমরা চাই না এসব হঠকারিতার হরতাল-অবরোধ। আমরা চাই শান্তি। কঠোর আইন এবং এর কঠোর-পক্ষপাতহীন প্রয়োগই এক্ষেত্রে হতে পারে পরম নিদান। সরকার যেন সেদিকেই এগোয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা,জানুয়ারি ১১, ২০১৫