ঢাকা: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত করতেই কৌশলে বিএনপিকে ব্যবহার করে চলমান আন্দোলনে সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। ২০ দলের ব্যানারে ডাকা অবরোধ ও হরতালের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বিপাকে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতামত, বাংলানিউজের বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এমনই সব তথ্য উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী গ্রেফতার হওয়ার আগেই রাজধানীসহ সারা দেশে নাশকতার পরিকল্পনা তৈরি করেন। কৌশলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ‘বন্ধের’ দাবিতে যে সকল আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিলো সেগুলোতে ‘লোক দেখানো’ ছাড়া তেমন সহিংস ভূমিকা রাখেনি জামায়াত।
কিন্তু এবার ২০ দলের ব্যানারে জোটের মূল দল হিসেবে বিএনপিকে পেয়ে আন্দোলনে সহিংসতার মূল কাজটি করছে তারা। কারণ পেট্রোল বোমাসহ সহিংসতার পরোক্ষভাবে দায়ভার বিএনপির ওপরই পড়বে মনে করেছে জামায়াত।
সম্প্রতি সারাদেশের রংপুর, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় বড় নাশকতায় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হওয়ার কারণে জামায়াত নিজেদের অনেকটাই সুরক্ষিত মনে করে এসব করছে বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুস সোবহানের রায় যেকোনো দিন দেওয়ার ঘোষণা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু দুই মাস পার হলেও রায় ঘোষণার তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়নি।
এদিকে তিন মাস পার হলেও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। অথচ আড়াই মাসের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও রায় কাযর্কর হয়েছিল আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার।
২০ দলের চলমান আন্দোলনে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করে বিচারকার্যে এ ‘দীর্ঘসূত্রতা’ তৈরি করতে পারাটাকে নিজেদের একটি বড় অর্জন বলে মনে করছে জামায়াত।
আর বিএনপিও কর্মী সঙ্কটের কারণে জামায়াতের সহিংসতার সঙ্গে নিজেদের কিছুটা সম্পৃক্ততা রেখে আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলমান হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে দেশের জামায়াত ‘অধ্যুষিত’ জেলা শহর ও এলাকাগুলোতে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে যে ৭৬ জনকে আটক করা হয়েছে তার ৫১ জনই জামায়াত-শিবিরের কর্মী।
এছাড়া এ বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর আদাবর, পল্লবী, মোহাম্মাদপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, খিলগাঁও, নিউমার্কেট, মতিঝিল, গাবতলীসহ একাধিক স্থানে ককটেল ও পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণসহ পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় বিএনপির অঙ্গসংগঠনের গুটিকয়েক কর্মীকে আটক করা হলেও সিংহভাগই আটক হয়েছেন জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের কয়েকজন নেতা নিহত ও গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
রাজনীতি বিশ্লেকেরা মনে করছেন, এতো বড় সহিংসতার পেছনে অবশ্যই জামায়াতের মতো সহিংস দলের প্রত্যেক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে এতে বিএনপির ইমেজ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রফেসর ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. খুরশিদা বেগমও এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কৌশল হিসেবে জামায়াত-শিবির এ সহিংসতাকে বেছে নিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর দোষটা পরোক্ষভাবে বিএনপির ওপর যাওয়ায় তারা ভয়াবহ সহিংস হয়ে উঠেছে। তবে যুদ্ধপরাধীদের বাঁচানো ছাড়াও মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো এবং ক্ষমতায় গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে জামায়াতের।
তবে কৌশল নয়, একে ‘দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার’ আন্দোলন উল্লেখ করলেন কয়েকজন জামায়াত ও শিবিরের নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামের একাধিক সদস্য বলেন, ‘জামায়াত নেতাদের বিচার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা সব সময় ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন, এখনো আছেন। তবে চলমান আন্দোলন বিচার ঠেকানো নয়, দেশ ও ‘গণতন্ত্রের রক্ষায়’ আন্দোলন।
১৯৯৬ সালসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াত ভূমিকা রেখেছে বলে দাবিও জামায়াত-শিবির নেতাদের।
আর বিএনপিকে ‘ব্যবহারের’ সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রহমান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি শক্তিশালী ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কোনো দলের পক্ষেই বিএনপিকে ব্যবহারের সুযোগও নেই। যদি ‘জামায়াতসহ’ অন্যান্য যেকোনো দল সহিংসতায় জড়িত থাকে তাহলে সরকার তাদের খুঁজে আটক করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৫