ঢাকা: নিজ নিজ অটল অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন দুই নেত্রী। এক চুল করে হলেও যার যার অবস্থান থেকে নড়েছেন তারা।
তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থান বিবেচনায় যারা মনে করছিলেন, দুই নেতার কাছে দেশ নয়, ক্ষমতাই বড়, তারা ধারনা বদলাতে বাধ্য হবেন।
এসব অভিমত দুই নেত্রীর শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও। তারা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে এমন পরিবর্তনই কাম্য। বুধবার (৪ মার্চ) দুই পক্ষের আচরণেই কিছু আশা জাগ্রত হয়েছে তাদের মধ্যে।
শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ ভক্তরা সব কৃতিত্ব তাকেই দিচ্ছেন। তাদের মতে, চলমান হরতাল-অবরোধে জনজীবনের ভোগান্তি সইতে পারছেন না শেখ হাসিনা। যদিও হরতালের কোন লক্ষণ নেই রাজপথে, তবু সহিংসতায় ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। সার্বিকভাবে দেশের যে কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার দায় না থাকলেও দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাঁধেই বর্তায়। আর সে কারণেই নমনীয় থেকে খালেদা জিয়াকে বারবার সুযোগ দিচ্ছেন।
তবে বুধবার থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকেও একটা স্বাভাবিক অবস্থার আভাস মিলছে।
এক্ষেত্রে কূটনীতিকদের অবদানকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, ১৬ দেশের কূটনীতিকের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফল এটি। সরকার পক্ষ ও বিএনপি’র মধ্যে মধ্যস্থতা করছেন তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসাতে না পারলেও দুই পক্ষের মনোভাব পরস্পরের কাছে ইতিবাচকভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন কূটনীতিকরা। আর তাতেই পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, কিছুটা সুবাতাস বইছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
বিশেষ করে, মঙ্গলবার (০৩ মার্চ) খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বিষয়টিতে কাজ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট একাধিক প্রস্তাব নিয়ে তারা সেখানে গেছেন।
এর আগে সরকার পক্ষকেও এ কূটনীতিকরা অনুরোধ করেছেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে।
এভাবেই ত্রি-মূখী অবদানে সুফল আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।
৪ মার্চ আদালতে খালেদার আত্মসমর্পণের কথা, তা নিয়ে টানা কয়েকদিন নানা জল্পনা-কল্পনা-উত্তেজনা চলছিল। কারন তার ওপর রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, রয়েছে তার কার্যালয়ে তল্লাশির নির্দেশও।
সেই টান টান উত্তেজনার মাঝেই বিএনপি থেকে জানানো হয়, আত্মসমর্পণ নয়, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর চেহলাম পালন করবেন খালেদা।
শেষ পর্যন্ত হলও তাই। আর এ বিষয়টি মেনে নিলো সরকারও। কোন প্রকার কঠোরতার ধার দিয়ে গেল না প্রশাসন।
খালেদার অপেক্ষায় আদালতে বিকেল পর্যন্ত ছিলেন বাদী প্রক্ষের আইনজীবীরা। কিন্তু চেহলামে ব্যস্ত রইলেন খালেদা, আদালতে গেলেন না।
মিডিয়ার আগ্রহ তবুও ছিল গুলশান ঘিরে। বিশেষ করে রাতে একটা কিছু হতে পারে- ভেবেই সেখানে জড়ো ছিলেন সংবাদকর্মীরা।
গুঞ্জন ছিল- খালেদাকে গ্রেপ্তার করা না হলেও তল্লাশিতে গিয়ে খালেদার সঙ্গে অন্য অবস্থানকারীদের বের করে দেবে পুলিশ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি।
জাতির মনোযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায়।
বিকেলে সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন তিনি। ‘কেন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না’- এমন এক প্রশ্নের জবাবে কৌশলী শেখ হাসিনার উত্তরের সারমর্ম ছিল- ‘খালেদা জিয়া জনরোষ থেকে বাঁচতে কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছেন। ’
সুনির্দিষ্ট কারন বা দিনক্ষণ উল্লেখ করলেন না অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী। কন্ঠস্বরেও কিছুটা পরিবর্তন পেলেন কেউ কেউ।
খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে আগ্রহীরাও হতাশার মাঝে আশা পেলেন।
কারন গুলশান কার্যালয়ে তিনি অবস্থান করছেন দুই মাসেরও বেশিদিন (০৩ জানুয়ারি থেকে) ধরে। এই সময়টিতে তার রাজনীতি বিজ্ঞপ্তি নির্ভর হয়ে পড়ে।
বুধবারও এসেছে বিজ্ঞপ্তি, তবে সেটি যুগ্ম-মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষর নিয়ে। খোদ খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য আসেনি।
পরে অপর বিজ্ঞপ্তিতে চেহলাম অনুষ্ঠানের মোনাজাতের ছবি পাঠানো হয়।
এটাকেই প্রতিক্রিয়া বলে ধরে নিলেন কেউ কেউ, যেন খালেদা বোঝালেন- হরতাল-অবরোধ বা সরকারকে আঘাত করায় নয়, তার মনোযোগ এখন ছেলের চেহলামে।
এভাবেই দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে আনন্দিত হচ্ছেন অনেকে। ভাবছেন, দুই পক্ষই সামনে হয়তো আরও সহনশীলতা ও নমনীয়তার পরিচয় দেবেন, জনগণের জন্য কোন সুখবর আসছে।
এর মধ্যে ভিন্ন আলোচনায়ও কেউ কেউ প্রমাণ করতে চাইছেন- খালেদার প্রতি সরকার নমনীয়।
খালেদার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থানায় পৌঁছেনি- বলে দাবি করা হচ্ছে।
এই দাবি থেকে প্রমাণ হয়, সরকারই আসলে খালেদাকে গ্রেপ্তারে আগ্রহী নয়, বরং এটি তাকে শাসনের কৌশল।
এভাবেই মঙ্গল ও বুধবারের সামগ্রিক চিত্রে আশার সঞ্চার হচ্ছে জনমনে।
আদালত ও প্রশাসনে খালেদা-প্রসঙ্গে সরকার প্রভাব রাখছে বলে মন্তব্যতো বরাবরের।
এসব প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, সরকার দলের এক সিনিয়র নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘যা হবে, জনগণ দেখবে। এখানে নতুন কি? আমরা সবসময়ই দেশের স্বার্থে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি। আদালত, প্রশাসন, সরকার- সবই মানুষের জন্য। মিলেমিশেই কাজ করবে- এটাই স্বাভাবিক। এটিকে কোনভাবেই নেতিবাচকভাবে চিন্তা করা ঠিক না। ’
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতিতে প্রতিদিনই নতুন কিছু হয়, আবার কোনকিছুই নতুন বা শেষ নয়। বিএনপি বলুন, আর আওয়ামী লীগ বলুন, মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে পুরোপুরি অস্বীকার করে কেউ রাজনীতি করে না। ’
তিনি বলেন, মানুষ শান্তি চায়, বিএনপি জনগণের শান্তি ও স্বস্তির জন্য কাজ করেছে সব সময়। সরকারের চাওয়াও যদি একই হয়, তাহলেতো কোন সমস্যাই থাকে না।
একই প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সহিংসতায়ে বিএনপি কোনকালেই বিশ্বাস করেনি। সহিংসতা বিএনপি করছে না। তাই ‘সহিংসতা বন্ধ করলে এমনটি হবে-তেমনটি হবে’- বলে লাভ নেই।
‘তবে কর্মসূচি তুলে নিতে বললে কর্মসূচির পেছনের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার বিনীত অনুরোধই করবো আমরা। কারণ আমরা এখনো বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের মতো পুরনো একটি দল জনগণের আশাকে মূল্যায়ণ করবে’– যোগ করেন এই নেতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘন্টা, মার্চ ০৫, ২০১৫