ঢাকা: গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ‘নাশকতা নির্ভর’ আন্দোলনের দুই মাস পুরো হলো।
গত ৬ জানুয়ারি থেকে চালিয়ে আসা অবরোধ-হরতালে ২০ দলীয় জোটের জন্য দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক অর্জন না থাকলেও ৬০ দিনের সহিংস আন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে; যাতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
বিএনপি-জামায়াতের দুই মাসের টানা অবরোধে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১১৫ জন, যার ৯০ জনই সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৬২ জন এবং ককটেল, সংঘর্ষ, গুলিতে বাকিরা। দলের মধ্যেও অনেকে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা গেছেন।
শুধু প্রাণহানি নয়, জামায়াত-বিএনপির ‘সহিংস’ আন্দোলনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ঘর থেকে বের হওয়া মানুষগুলো এখন পথ চলছে আতঙ্ক নিয়ে। অর্থনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটানা এত দিন ধরে অবরোধ-হরতালের ইতিহাস নেই। অতীতে এ রকম নাশকতা বা সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেনি। তা ছাড়া আগে কখনোই সাপ্তাহিক ছুটি বা জাতীয় দিবসে আন্দোলন কর্মসূচি থাকত না।
তারা বলছেন, অতীতের কোনো আন্দোলনে এভাবে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে হামলা হয়নি। আগে রাজনৈতিক আন্দোলন মানে ছিল পুলিশের হামলা, তাদের সঙ্গে মারামারি কিংবা দুই পক্ষের সংঘর্ষ। কিন্তু এখন রাজনীতির অস্ত্র পেট্রলবোমা আর ক্রসফায়ার ও গ্রেপ্তার-মামলা।
এ পর্যন্ত নিহত ৯০ জন সাধারণ মানুষের মধ্যে ৩৩ জন বাস বা অন্য কোনো বাহনের যাত্রী। চালক মারা গেছেন ৯ জন এবং চালকের সহকারী ১১ জন ।
এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে নয়জন শ্রমিক বা দিনমজুর, একজন পথচারী, পাঁচজন ছাত্র, দুজন প্রবাসী, সাতজন শিশু এবং নয়জন নারী, একজন পুলিশ সদস্য।
প্রত্যক্ষদর্শী, নাশকতার শিকার হয়েও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস, ট্রাক বা যানবাহনে আচমকা হামলার ঘটনায় এসব প্রাণহানি ঘটেছে।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর আগে টানা অসহযোগ কর্মসূচি চলেছে ২০ দিন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচি দিয়েছিল।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয়েছে এরশাদ সরকারের পতনের দাবিতে। আট বছর বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে চিকিৎসক শামসুল আলম মিলন মারা গেলে এরশাদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এর পরই টানা আন্দোলন শুরু হয়। তবে ৯ দিনের মাথায় (৫ ডিসেম্বর) এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ায় আন্দোলন আর টেনে নিতে হয়নি।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক আন্দোলন ও সহিংসতার তীব্রতা বাড়ে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হয়, সে জন্য ’৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে।
কিন্তু বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মেনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে দুর্বার আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ। আন্দোলন দমাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ সময় পুলিশের গুলি ও সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন। এর মধ্যেই নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করে বিএনপি।
এরপর বিএনপি সরকারের পতনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো ৯ মার্চ থেকে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে। টানা ২০ দিন এই অসহযোগ কর্মসূচি চলে। এই আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯ জন মারা যান।
২৮ মার্চ রাষ্ট্রপতি সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল আনলে ৩০ মার্চ অসহযোগ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। ওই দিন খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের আন্দোলন একটি যৌক্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দেয় এবং ১ অক্টোবরে নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে।
কিন্তু নির্বাচনের আগের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯৬ জন মারা যান। এদের মধ্যে ৭৯ জনই ছিলো রাজনৈতিক কর্মী, ১৭ জন সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আবার সংঘাতের ঘটনা ঘটে ২০০৬ সালের অক্টোবরে। বিএনপির সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে চাইলে আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে। ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে সংঘর্ষে সারা দেশে ১২ জন নিহত হন। পরদিন মারা যান ২৪ জন। এদের প্রায় সবাই ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম সংসদ নির্বাচনের কথা থাকলেও ৭ জানুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ আবার অবরোধ ডাকে। এই আন্দোলন শুরুর মাত্র চার দিনের মাথায় ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর পর ২০০৮ সালে নির্বাচন নিয়ে সহিংসতায় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার ঘোষণা দিলে আবার ভয়াবহ সংঘাত শুরু হয়।
এ বছর ২৫ নভেম্বর দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে টানা আন্দোলন শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোট। মাঝখানে এক বা দুই দিনের বিরতি দিয়ে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় দফা অবরোধে চলে বিরামহীন নাশকতা। জনসম্পৃক্তহীন এ আন্দোলনে ২৬ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল অবরোধে প্রাণ হারান ৭৫ জন। এদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ।
বিএনপি জামায়াতের ওই সহিংস আন্দোলনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় প্রাণ হারান ৩৪ জন। ওই নির্বাচনের বর্ষপূতির দিন (৫ জানুয়ারি ২০১৫) থেকে আবারও সংঘাত-সহিংসতা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই মাসে বিএনপির অর্জন শূন্য। দলটি মুখে মুখে ঘোষণা দিয়ে হরতাল-অবরোধ করছে, যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বরং এই প্রাণহানি ও জাতীয় সম্পদ নষ্ট করায় রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও দেশের বাইরে ইমেজ সংকটে পড়েছে বিএনপি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৫