ঢাকা: পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পেলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী রোববার (৫ এপ্রিল) আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। খালেদার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা দুই দুর্নীতি মামলার শুনানির জন্য ওইদিন বিচারিক আদালতে দিন ধার্য রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ কথা জানান খন্দকার মাহবুব হোসেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুই দুর্নীতি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে রাজধানীর বকশিবাজারে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদারের অস্থায়ী আদালতে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে আগামী ৫ এপ্রিল। খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েও শুনানি হবে সেদিন।
এসব বিষয়সহ মামলা দু’টির শুনানির ধার্য তারিখে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হবেন, তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকতে হবে- এমনটাই জানালেন তার উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন।
কেন নিরাপত্তা প্রয়োজন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এর আগে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে।
গত ৪ মার্চ শুনানি শেষে দুই দুর্নীতি মামলায় প্রধান আসামি খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রাখেন আদালত। অন্য দু’জন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি। তারা হচ্ছেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে শুনানিতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
আসামিপক্ষের একটি আবেদন মঞ্জুর করে আদালত ওইদিন মামলাটির অপর আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন বলেও আদেশ দেন।
খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অনুপস্থিতিসহ ওইদিন মোট সাতটি আবেদন জানিয়েছিলেন আসামিপক্ষ। আবেদনগুলোর নিষ্পত্তির পর চারটি আবেদন নথিভুক্ত রেখে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেন আদালত। ফলে রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী আদালতে উপস্থিত থাকলেও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি মোট ছয়জন। খালেদা-তারেক ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিভুক্ত দু’জন ছাড়া অন্য দু’জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা ছাড়া অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন- খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান জামিনে আছেন। হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী হচ্ছেন- দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার বাদী হারুন-অর রশিদ, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার হারুনুর রশিদ, অফিসার (ক্যাশ) শফিউদ্দিন মিয়া, আবুল খায়ের, প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা নাজমা পারভীন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আফজাল হোসেন।
সাক্ষীদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন বাদী ও প্রথম সাক্ষী দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে কোনো আসামি না থাকায় আসামিপক্ষের জেরা বাতিল করেছিলেন আদালত। তবে তারেক রহমানের পক্ষে আগামী ধার্য তারিখে (৫ এপ্রিল) হারুন-অর-রশিদকে জেরা করার সুযোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।
অন্যদিকে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।
দুই মামলারই বাদী হলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।
জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।
গত বছরের ১৯ মার্চ দুই দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ঢাকা তৃতীয় ও বিশেষ জজ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে চার্জ গঠন করা হয় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর আট আসামির বিরুদ্ধেও।
গত বছরের ৭ মে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঢাকার মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আদালত ভবনের পরিবর্তে ঢাকা মহানগরের বকশীবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালত ভবনে চালানোর আদেশ জারি করে।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে আইন মন্ত্রণালয় এ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়ের বদলে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ হিসাবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু আহমেদ জমাদারকে। আগের বিচারকের প্রতিও অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানানো ছাড়াও তার আদালতে বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে এজলাসকক্ষেই বিশৃঙ্খলা ও হই-হট্টগোল এবং বিচারকের প্রতি কটূক্তি করে আসছিলেন খালেদার আইনজীবীরা।
এ পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক বদল করা হয়।
নানা কারণ দেখিয়ে মামলা দু’টির শুনানির জন্য নির্ধারিত ৬৫ কার্যদিবসের মধ্যে ৫৮ কার্যদিবসই অনুপস্থিত থেকেছেন খালেদা জিয়া, হাজির হয়েছেন মাত্র ৭ দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৫