ঢাকা: জেলে বসে নিজের এবং দলের সম্ভাব্য পরিণতির কথা আঁচ করতে পেরে একাত্তরের ‘ঘাতকমুক্ত’ নতুন একটি জামায়াত গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন দলটির সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
কাঙ্খিত নতুন জামায়াতের একটি ফরমেটও দাঁড় করিয়েছিলেন একাত্তরের এই ঘাতক।
সূত্রমতে, ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আটক হওয়ার পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণের চিন্তা থেকে নিজেসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলের আটক নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা এবং যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতের করুণ পরিণতি আঁচ করতে পেরে দলের আমূল সংস্কারের কথা বলেছিলেন কামারুজ্জামান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে কামারুজ্জামান চেয়েছিলেন যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা জামায়াত থেকে সরে দাঁড়াবে এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ নতুন জামায়াতটি হবে নতুন প্রজন্মনির্ভর জামায়াত। এরা প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ‘ধর্মহীন’ শক্তির মোকাবিলা করবে। দলের শীর্ষনেতাদের মধ্যে যারা জেলে আটক আছেন তাদের যা হবার হবে। এদের পরিণতি নিয়ে নতুনদের ভাবতে হবে না।
সূত্র জানায়, নিজের প্রস্তাবনার পক্ষে একটি বিস্তারিত রূপরেখাও দিয়েছিলেন কামারুজ্জামান। তাতে সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে ঢোকানো’ এবং কৌশলের অংশ হিসেবে যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করার কথাও বলেছিলেন তিনি।
তবে ‘ঠেলায় পড়ে’ চৈতন্য ফিরে পাওয়া একাত্তরের ঘাতক কামারুজ্জামানের ওই পরিকল্পনায় সায় দেয়নি স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন জামায়াত। ওই প্রস্তাবে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে তারা অস্বস্তিতে পড়েন।
কামারুজ্জামানের ওই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজাহারুল ইসলাম (বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে কারাবন্দি আছেন) বলেছিলেন, যারা কারাগারে আছেন, তাঁরা দল পরিচালনার জন্য বাইরের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা করেন, তা হবে দল ভাঙার ষড়যন্ত্র।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিজের পরিল্পনার কথা জানিয়ে ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে গোপনে একটি চিঠি পাঠান কামারুজ্জামান। দলের উদ্দেশে লেখা ওই চিঠিতে তিনি জামায়াতের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে তিনটি বিকল্প উল্লেখ করেন।
সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করে ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, মিডিয়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে, তাহলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে দেশে-বিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ থাকবে না। ফলে জামায়াতকে টিকিয়ে রাখতে হলে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে তাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভার ধারণা গ্রহণ করতে হবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ওপর গুরুত্বরোপ করতে হবে। যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করতে হবে। সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।
ওই চিঠির জবাবে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ও জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী ২০১১ সালের ১১ ও ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় লেখেন, জামায়াত মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো কর্মকৌশল নয়, বরং শাশ্বত কর্মকৌশলই অবলম্বন করতে হবে। পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক, চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক; শর্টকাট কোনো পথ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৫
এজেড/জেডএম