ঢাকা: সরকার পতনের লক্ষ্যে টানা ৯২ দিনের ‘নিষ্ফল’ আন্দোলন অমীমাংসিত রেখে রোববার (০৫ এপ্রিল) খালি হাতে ঘরে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ১১৮ কর্মকর্তা এখনো রয়েছেন লোক-চক্ষুর অন্তরালে।
তথাকথিত ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে টানা তিন মাসের ‘নাশকতানির্ভর’ আন্দোলনে যেমন তাদের দেখা যায়নি, তেমনি ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দেখা মিলছে না পদ আগলে থাকা এসব কর্মকর্তাকে।
অথচ তিন সিটি নির্বাচনে দলের অস্তিত্ব জানান দিতে এবং ব্যাকফুটে যাওয়া নেতা-কর্মীদের ফ্রন্টফুটে আনতেই আন্দোলনকে মাঝপথে রেখে গুলশান কার্যালয় ছেড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
কিন্তু রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে খালেদা জিয়া বের হলেও আত্মগোপনে থাকা বিএনপির নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তারা বেরই হচ্ছেন না। কেবল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুই জন সহ-দপ্তর সম্পাদক ও মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা-কর্মীর আনাগোনা দেখা গেছে গত ৫ দিনে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ১১৮ কর্মকর্তার মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক মামলা। সে কারণেই হয়তো কেউ বাইরে আসছেন না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবাই বেরিয়ে আসবেন এবং দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে এই মুহূর্তে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ মোট ১শ’ ১৮ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
এদের মধ্যে ১৬ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব, ৭ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ৭ জন সহ- সাংগঠনিক সম্পাদক, ৬ জন আন্তর্জতাকি বিষয়ক সম্পাদক ও ১ জন বিশেষ সম্পাদক রয়েছেন।
এ ছাড়া ‘কোষাধ্যক্ষ’, ‘প্রচার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘আইন’, ‘শিক্ষা’, ‘সমাজকল্যাণ’, ‘যুব’, ‘স্থানীয় সরকার’, ‘শিল্প’, ‘অর্থনীতি’, ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসন’, ‘তথ্য ও গবেষণা’, ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘ক্রীড়া’, ‘মহিলা’, ‘প্রশিক্ষণ’, ‘ছাত্র’, ‘শ্রম’, ‘কৃষি’, ‘স্বেচ্ছাসেবা’, ‘গণশিক্ষা’, ‘ধর্ম’, ‘বন ও পরিবেশ’, ‘পরিবার পরিকল্পনা’, ‘সমবায়’, ‘পল্লী উন্নয়ন’, ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প’, ‘গ্রাম সরকার’, ‘প্রকাশনা’, ‘স্বনির্ভর’, ‘তাঁতী’, ‘শিশু’, ‘স্বাস্থ্য’, ‘প্রবাসী কল্যাণ’, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’, ‘তথ্য ও প্রযুক্তি’, ‘উপজাতি’, ‘মৎস’ এবং ‘সংস্কৃতি’-এ ৩৯টি সাংগঠনিক পদে সম্পাদক, সহ-সম্পাদক ও উপ-সম্পাকদ মিলে মোট ৭৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তাই দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিবের নির্দেশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে থাকেন। আন্দোলন কর্মসূচি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা এদের মাধ্যমেই মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে।
কিন্তু ৩ জানুয়ারি বাসা ছেড়ে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে খালেদা জিয়া আন্দোলন শুরু করলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ১১৮ কর্মকর্তাকে আর মাঠে দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের পর নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তার মধ্যে বেশ কয়েকজন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরবাসি, মারা গেছেন ৫ জন, নিখোঁজ হয়েছেন ২ জন, বিদেশে অবস্থান করছেন বেশ কয়েকজন, বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ। বাকিরা সবাই আত্মগোপনে।
খালেদা জিয়ার পর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মকর্তা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় সাত বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থানরত বিএনপির এই ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সম্প্রতি বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে দেশ-জাতি ও বিএনপির প্রগতিশীল অংশের বিরাজভাজন হন। এখন তিনি নীরব আছেন।
২০১১ সালের মার্চ মাসে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চলমান অনির্দিষ্টকালের অবরোধের প্রথম দিন ৬ জানুয়ারি প্রেসক্লাব থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান টিএইচ খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বেগম রাবেয়া চৌধুরী ভুগছেন বার্ধক্যজনিত রোগে। ঘর থেকে বেরিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে শরিক হওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা প্রবীণ এই রাজনীতিবিদদের নেই।
ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও আব্দুস সালাম পিন্টু আছেন কারাগারে। সম্প্রতি মারা গেছেন অ্যাডভোকেট হারুন আল রশিদ।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা গত দেড় বছর ধরে অবস্থান করছেন আমেরিকায়। সম্প্রতি লন্ডনে ঘুরে গেলেও বাংলাদেশে আসেননি তিনি। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
এছাড়া ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, এম মোর্শেদ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, বেগম সেলিমা রহমান ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ- দলের এই সাত ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কেউ বহিষ্কৃত, কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউ আত্মগোপনে, কেউবা সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন বলে জানা গেছে।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ গত ১০ মার্চ উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। ঘটনার ২৮ দিন পরও তার কোনো হদিস মেলেনি।
এ ছাড়া যুগ্ম মহাসচিব মো. শাজাহান ও রুহুল কবির রিজভী আছেন কারাগারে। আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, বরকত উল্লাহ বুলু রয়েছেন আত্মগোপনে। কেবল ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকন আদালতে দৌড়াদৌড়ি করছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা নিয়ে।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হন। ঘটনার ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি।
অপর ৬ সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, গোলাম আকবর খোন্দকার, মসিউর রহমান, হারুন অর রশিদ, মুজিবুর রহমান সরোয়ার ও আসাদুল হাবিব দুলু রয়েছেন আত্মগোপনে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে পিলখানায় বিডিআর হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি আছেন কারাগারে। এছাড়া সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম চৌধুরী, আব্দুল মমিন তালুকদার খোকা, নজরুল ইসলাম খান রাজন, ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন আন্দোলনের শুরু থেকেই রয়েছেন আত্মগোপনে।
তবে আরেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু রাজপথেই রয়েছেন। স্থানীয় বিএনপির কর্মসূচিতে এখনো সরব রয়েছেন তিনি।
বিএনপির বিশেষ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা আন্দোলনের শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। যুব বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দীর্ঘদিন কারাবাসের পর বৃহস্পতিবার (০৯এপ্রিল) জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক রয়েছেন আত্মগোপনে।
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস কাদের চৌধুরী, লুৎফর রহমান খান আজাদ, জাকারিয়া তাহের সুমন রয়েছেন আত্মগোপনে। আ ন ম এহছানুল হক মিলন গত দুই মাস ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। এখন তিনি মালদ্বীপে অবস্থান করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
আরেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কমর উদ্দিন আহমেদ পরলোকগত। ড. আসাদুজ্জামান রিপন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র তুলে অনেকদিন পর জনসম্মুখে আসেন।
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক উইং কমান্ডার (অব.) হামিদ উল্লাহ খান মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। তার এ পদে এখন পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আব্দুল সালাম, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবীব উন নবী খান সোহেল, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাছির উদ্দীন আহমেদ অসীম রয়েছেন আত্মগোপনে।
এ ছাড়া বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আরো প্রায় ৬৮ জন কর্মকর্তার বেশিরভাই রয়েছেন আত্মগোপনে। খালেদা জিয়া বাসায় ফিরে গেলেও আত্মগোপন থেকে তারা বের হচ্ছেন না। মামলায় জর্জরিত এসব নেতা কবে নাগাদ আত্মগোপনদশা থেকে জনসম্মুখে আসেন- সেটি দেখার প্রত্যাশায় রয়েছেন দলের হাইকমান্ড।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘রাজপথের বিরোধীদল’ বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তারা এভাবে আত্মগোপন ও জনগণ থেকে দূরে থাকার কারণে ক্ষমতাসীনরা এবারের আন্দোলনকে পাত্তা দেয়নি। অধিকন্তু আন্দোলনের নামে সারাদেশে যে ‘নাশকতা’ হয়েছে যৌক্তিক কারণে তার দায় বিএনপির ওইসব নেতার ওপরই বর্তিয়েছে। কেননা, নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দিক-নির্দেশনা অন্তরাল থেকেই আসে!
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৫
এজেড/জেডএম