ঢাকা: আর মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা, কেবল রাত পোহানোর দেরি! এরপরই শুরু হবে বহুল প্রতীক্ষিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। যে নির্বাচনে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ও সম্মান প্রদর্শণ করে বিশ্লেষকদের মন কেড়েছেন প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদীর্ঘ ১৩ বছর অপেক্ষার পর ঢাকার নাগরিকরা অন্যরকম একটি নির্বাচন দেখছেন। সচেতন ও পোড়-খাওয়া নাগরিকরা অনেক কষ্টের পরেও এবার নিশ্চয়ই কিছু সান্ত্বনা নিচ্ছেন প্রার্থীদের দেখে। তাদের সুন্দর বোঝাপড়া রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনতে পারে বলে আশা করছেন অনেকে।
তারা আরও বলছেন, শুধু শুধু কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখেছেন এবারের প্রার্থীরা। শিক্ষিত ও বুঝদার প্রার্থীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতি পরিচ্ছন্নভাবেই করা সম্ভব। আরও বুঝিয়েছেন, প্রতিদ্বন্দ্বীতা মানে শত্রুতা নয়।
প্রার্থীদের আচরণে মুগ্ধ হয়েছেন স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
গত ১২ এপ্রিলের কথা- রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে উত্তরের প্রার্থীদের সঙ্গে কমিশনের একটি মতবিনিময় সভায় তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি।
কমিশনের কর্মকর্তারা বসে ছিলেন মঞ্চে। সামনেই পাশাপাশি হাসিমুখে বসে ছিলেন ১২ জন মেয়রপ্রার্থীসহ কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আনিসুল হক, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, মাহী বি. চৌধুরী, জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকী, আব্দুল্লাহ আল ক্বাফি রতনের পারস্পরিক কথোপকথনের ভঙ্গি নজর কেড়েছে সবার।
একেকজন যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, অন্যরা মাথা নেড়ে ও হাততালি দিয়ে সায় দিচ্ছিলেন। সহমত প্রকাশ করছিলেন পরস্পরের সঙ্গে।
সবচে গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আনিসুল হক ও তাবিথ আউয়াল নিজেদের মধ্যে টুকটাক আলাপ করে নিচ্ছিলেন। সিইসি’র অভিজ্ঞ নজরে পড়ে সে দৃশ্যও। তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল মুগ্ধতা ও তৃপ্তি।
প্রচারণার তাগিদে কেউ কেউ সভায় বক্তব্য রেখেই চলে যান। সে মুহুর্তেও সংবাদকর্মীরা একই ফ্রেমে তাদের পেতে চাইলে, বিনা আপত্তিতে হাসিমুখে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ছবিতে এলেন।
সব দেখেশুনে মুগ্ধ সিইসি বলেন, এ নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে যে সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি, সেটি নজিরবিহীন।
দক্ষিণে ২০ দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাস মামলা জটিলতায় ভোটের মাঠে আসতে পারেন নি। কিন্তু কোনো অংশে পিছিয়ে নেই তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। স্বামীর হয়ে সারা দক্ষিণ চষেছেন এ নারী।
১৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সবাইকে চমকে আব্বাসের সবচে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদ খোকনের বাসায় চলে গেলেন তিনি। নামাজ পড়ে একটু গল্প করে এলেন আফরোজা।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনও পরদিন বলেন, জয়ী হলে চাচা-চাচীর (আব্বাস ও আফরোজা) বাসায় যাব আমিও। দোয়া নেব তাদের।
আনিস বলছেন, তাবিথ আমার ছেলের মতো। তাবিথ বলছেন, আনিসের কথাবার্তা ও ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে।
এসব ঘটনার আলোচনা ওঠে এসেছে সাধারণ মানুষের আড্ডায়, টেলিভিশনের টক-শোগুলোতেও।
প্রচারণা শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে প্রার্থীরা পরস্পরের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন। নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে। নগরবাসীকে নিজেদের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা জানান প্রিয় এ নগরীকে নিয়ে।
কিন্তু এতো মুখোমুখিতেও সেভাবে কাউকে হেয় বা অসম্মান করেন নি কোনো প্রার্থী।
পরস্পরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগ করেছেন, কমিশন ও সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছেন বিরোধী শিবিরের প্রার্থী। কিন্তু বাচনভঙ্গি ও শব্দপ্রয়োগে তারা ছিলেন সচেতন, ভদ্র ও সংযমী।
প্রার্থীদের নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহকারী সংবাদকর্মীদের আলোচনায়ও এসেছে এসব। তারা দেখেছেন, কখনো খুনসুটি লেগেছে আনিস-মাহী, আনিস-ক্বাফীর। কখনো আনিসের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন কাজী মো. শহীদুল্লাহ ও আনিসুজ্জামান।
কিন্তু ঝামেলা সমাধায় এগিয়ে এসেছেন তাবিথ, সাকি বা অন্যরা। কিছুক্ষণ পরেই আবার সব ঠিকঠাক। কেউই সেসবের জের ধরে বসে ছিলেন না।
মাহীর ওপর হামলা হয়েছে। তিনি আনিস ও তাবিথের প্রতি অভিযোগও তুলেছেন। কিন্তু যারা আনিস ও তাবিথকে দেখেছেন-জেনেছেন, তারাই বলেছেন- এ দুই প্রার্থী এমন কিছু করার কথা নয়।
প্রচারণায় নেমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর হামলার শিকার হয়েছে টানা তিনদিন। অভিযোগ ওঠেছে আনিসের ওপর। কিন্তু অনেকেই আবার বলেছে, আনিস এসব করার মানুষ নন।
২০ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে উত্তর ও দক্ষিণের প্রার্থীদের নিয়ে বসেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বুয়েট’র নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান।
সবার কথা শুনে ও পারস্পরিক সম্বোধন দেখে মুগ্ধ নজরুল। তিনি বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে দেখে- কয়েকজন তরুণ ও তরুণমনা মানুষ নগরের দায়িত্ব নিতে উদগ্রিব হয়ে রয়েছেন। সবার একই চাওয়া- কী করে নগরের কল্যাণ হয়, কী করলে নগরবাসী ভালো থাকে। আপনাদের আচরণ ও কর্থাবার্তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে এমন সুন্দর সম্পর্কের প্রশংসা করতে হয়। ’
সারোয়ার জাহানের বক্তব্যও একই রকম। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে নগরের উন্নয়নে যেভাবে ভাবছেন, যা বলছেন- বোঝা যায়, এ নগর ভালো পিতা পেতে যাচ্ছে। ফলাফল যাই হোক না কেন, আপনাদের এ সম্পর্কগুলো যেন থাকে। একে অন্যকে সহযোগিতা করে এ নগরের কল্যাণ করবেন- সেটাই প্রত্যাশা। ’
প্রার্থীরা সাংবাদিকদের মুখোমুখিতে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে যেকোনো ফলাফলই তারা মেনে নেবেন।
তাই বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে ও পরবর্তী সময়টুকু ঠিক থাকলে- এ নির্বাচনটি আগামীর বাংলাদেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলছেন আশাবাদী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫
এসকেএস/বিএস