অবশেষে তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলো। দেরিতে হলেও তিন সিটির লক্ষ লক্ষ বাসিন্দা তিনজন নির্বাচিত নগরপিতা পেলেন।
বিতর্ক আর অভিযোগ সব নির্বাচনেই হয়। এ-যেন জন্মদাগের মতো নির্বাচনী ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেছে আমাদের। সংঘর্ষ, কারচুপি, কেন্দ্র দখল, জালভোট, অভিযোগ, কাদা ছোড়াছুড়ির দুষ্টচক্র থেকে কবে যে এদেশের শিশু গণতন্ত্র মুক্তি পাবে তা কেবল ভবিষ্যৎই জানে। অদূর না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো এসব থেকে মুক্ত হবে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি ও হোঁচট-খাওয়া গণতন্ত্র।
তবে এবার একসঙ্গে ঘটে গেল অনেক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। সবচেয়ে নজরকাড়া ব্যাপার হলো ভোট চলার মাঝপথে--- দুপুরের পর--বিএনপির মেয়রপ্রার্থীদের একযোগে নির্বাচন বর্জন। এমনটা আর কখনোই হয়নি। বিরোধী দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের একযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘটনাটি এদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অভিনব ও বিস্ময়কর। তাছাড়া আরো বেশকিছু ব্যতিক্রমী ব্যাপারও ঘটেছে এবার। যা একই সঙ্গে নানা কৌতূহল ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সকাল ৮ টায় ভোটগ্রহণ যখন শুরু হয় তখন সবকিছু শান্তিপূর্ণই ছিল। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরাও তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সকালে বেশিরভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি প্রার্থীদের বেশিরভাগ এজেন্ট ছিলেন অনুপস্থিত। এমনকি কেন্দ্রের বাইরে তাদের নির্বাচনী ক্যাম্প বলতেও কিছু ছিল না। ভোটারদের হাতে স্লিপ ধরিয়ে দেওয়ার যে চিরাচরিত রীতি সেখানটায় এবার ব্যত্যয় ঘটেছে। এমনটি সচরাচর দেখা যায়নি। অনেকে তাই প্রশ্ন করেছেন, ‘তাহলে কি বিএনপি প্রার্থীদের এজেন্টরা আগেভাগেই জানতেন তাদের মেয়রপ্রার্থীরা দুপুরে নির্বাচন বর্জন করতে যাচ্ছেন?’ এই প্রশ্নটা এতো সহজে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। আরও কিছু বিষয় বিএনপির অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
যেমন, বিএনপির অনেক র্শীর্ষ ও মাঝারি নেতাকে ভোট দেবার জন্য ভোটকেন্দ্রে যেতে দেখা যায়নি। এই পর্যবেক্ষণটা ভোটকেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের। কেন বিএনপির বেশিরভাগ শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের নেতা ভোট দিতে যাননি? দুপুরে ভোট বর্জন করবেন বলেই কি? দলের এক কর্মীর সাথে বিএনপির এক শীর্ষ নেতার মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া টলিফোন সংলাপও জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের।
সবচে অবাক করা একটা ব্যাপার সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেছেন বিএনপির ‘পলাতক’ মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের বেলায়। জনাব আব্বাস যাননি নিজেকে নিজের ভোটটি দিতে। এমনকি তার পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন ও নিকটজনদেরও নাকি ভোট কেন্দ্রে বা তার আশেপাশে একটিবারের জন্যও দেখা যায়নি। ‘যার বিয়ে তার খবর নাই/ পাড়ার লোকের ঘুম নাই’ -- ঢাকার অনির্বাচিত সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসের বেলায় সেটাই ঘটতে দেখা গেল। কিন্তু কেন? সে কি কেবল এমনি-এমনি?
ভোটকেন্দ্রে খোদ প্রার্থীর/প্রার্থীদের অনুপস্থিতি ও তাদের পরিবার-পরিজনদের অনুপস্থিতি, এজেন্টদের অনুপস্থিতি, শীর্ষ নেতানেত্রীদের অনুপস্থিতি, কেন্দ্রের বাইরে ক্যাম্প না বসানো ---এসবকিছু এক সুতোয় গাঁথা বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। মানে দাঁড়াচ্ছে, ভোট বয়কট/বর্জন হবেই, তা বোধ করি শীর্ষ নেতানেত্রী ও প্রার্থীদের সবারই কাছেই ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু শীর্ষ যে নেতানেত্রীরা ভোট দিতে কেন্দ্রে বা কেন্দ্রের ধারেকাছে যাননি তারাই আবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটে গেছেন সংবাদ সম্মলনে শরিক হতে। এ-ব্যাপারটাও দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের নজর এড়ায়নি। এতে অনেকের মতো তারাও অবাক হয়েছেন।
আর চট্টগ্রামে সদ্যসাবেক মেয়র এম মনজুর আলমও যুগপৎ জন্ম দিয়েছেন বিস্ময় ও কৌতূহলের। ‘আওয়ামী লীগার টার্নড বিএনপি’ বলে অভিহিত জনাব মনজুর তার দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ভোট বর্জন করেই থামেননি; রাজনীতি থেকে চিরবিদায়ের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে ফেললেন---অশ্রুসজল নয়নে। এখানটাতেই সবার মনে খটকা---কেন তিনি এমন ঘোষণা দিলেন? দলের সাথে কি তার বনিবনা হচ্ছিল না? রাজনীতি থেকে হঠাৎই কেন তার এই অকাল অগস্থ্যযাত্রা?
তাহলে কি অন্য কোনো অজানা রাজনৈতিক হিসাব ছিল বিএনপির? বিএনপি নির্বাচনমুখি দল নয় বলে বাজারে সমালোচনা চালু আছে (তাদের প্রতিপক্ষরা প্রায়শই বলে থাকে)। ভোট গ্রহণের মাঝপথে এসে হঠাৎই নির্বাচন বর্জন/বয়কটের ঘোষণা দিয়ে তারা সেই ধারণার পালেই কিছুটা হাওয়া দিলেন। অতীতে তারা অনেকবার অনেক নির্বাচন বয়কটের আগাম ঘোষণা দিয়েছেন, আর এবার ভোটাভুটির মাঝপথে এসে নির্বাচন বর্জন করেছেন। যদিও দুটোর মধ্যে মৌলিক বা গুণগত তফাত তেমন নেই। তবে চমক ও নাটকীয়তা আছে।
এবার আসা যাক, বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে। তাদের কিছু কিছু অভিযোগের সত্যতাও আছে। হালফিল প্রযুক্তির এযুগে সেসব মিডিয়ার নজর এড়ায়নি। পত্রপত্রিকায়, অনলাইনে, টিভি চ্যানেলে সেসব নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরাও হয়েছে। নির্বাচনে জাল ভোট কেন্দ্র দখল, এজেন্টদের উপর হামলার মতো নিন্দনীয় কাজ কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এইসব অপকর্ম নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে ম্লান করে, গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিটি নির্বাচনেই এমনটা ঘটতে দেখি আমরা। এসবের ব্যাপারে দেশের মানুষের মধ্যে সমালোচনা-ক্ষোভ যেমন আছে, তেমনি বিদেশিদের, বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যেও অসন্তোষ- হতাশা আছে। কিন্তু বিএনপি এবং কিছু মিডিয়া যেভাবে ঢালাওভাবে নির্বাচনকে ‘বেপরোয়া জালিয়াতির নির্বাচন’ বলে প্রতিপন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেটাও অবিবেচনাপ্রসূত। সবক’টি কেন্দ্রেই কারচুপি জালিয়াতি হয়েছে এমন দাবি করার পেছনে যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে আমরা মনে করি না।
তিন সিটিতে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ২ হাজার ৭শটি। তাহলে অনিয়ম, সংঘর্ষ কি সবক’টিতেই হয়েছে? একটি জাতীয় দৈনিক হিসেব করে দেখিয়েছে হাঙ্গামা-সংঘর্ষ হয়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৫৫টি। সংখ্যাটা কমবেশি হতে পারে। কিন্তু সব কেন্দ্রেই নৈরাজ্য-অনিয়ম হয়েছে বলার যাবে কি?
দৈনিকটি তিন সিটির মোট ভোটকেন্দ্র ও হাঙ্গামা হয়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা তুলে ধরেছে। পাশাপাশি সেখানে ভোটারদের মোট সংখ্যার অনুপাতে অনিয়ম-হওয়া-কেন্দ্রগুলোর ভোটার সংখ্যার হিসেব তুলে ধরে বলেছে, বিএনপির ঢালাও অভিযোগ সত্য নয়। পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে যা বলেছে তার একাংশ হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘‘বিচ্ছিন্ন কিছু গোলযোগের ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ঢাকার দুই সিটির এক হাজার ৯৮২টি কেন্দ্রের মধ্যে গোলযোগ হয়েছে অর্ধশত কেন্দ্রে। দুই সিটিতে মোট ভোটার ৪২ লাখের বেশি। বিপরীতে হাঙ্গামা হওয়া কেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার এক লাখের বেশি নয়। ঢাকায় তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ২৫টির মতো কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়নি। এখানে মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার আর মোট কেন্দ্র ৭১৯টি। বিপরীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেছে ৫-৭টি কেন্দ্রে যেখানে ভোটার সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার। ’’
তাহলে নির্বাচনকে এককথায় কী করে জালিয়াতির নির্বাচন বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? আর কারচুপি-জালিয়াতি সার্বত্রিক হয়ে থাকলে বিএনপির মেয়রপ্রার্থীরা কী করে লাখ লাখ ভোট পেলেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার ঠিক এ-প্রশ্নটাই করলেন। এ প্রশ্নের জবাব কি আছে বিএনপির কাছে? দেখা যাক, বিএনপি এ ব্যাপারে কি জবাব দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৫
জেএম/