ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

রাজনীতি

জামায়াতি স্টাইল, পরিণতি অনিবার্য

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৮ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৫
জামায়াতি স্টাইল, পরিণতি অনিবার্য ফাইল ফটো

ঢাকা: দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্তমান পরিণতির জন্য স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে দলটির অতিরিক্ত সখ্য’কে দায়ী করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
 
বিএনপির প্রগতিশীল অংশের ধারণাও অনেকটা একই রকম।

তারা বলছেন, অতিমাত্রায় জামায়াত নির্ভরতা, জামায়াত প্রীতি এবং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘জামায়াতি ধরন’ অবলম্বন করার কারণে মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে বিএনপি। আন্দোলনের ক্ষেত্রে জামায়াতি স্টাইল ফলো করায় অনিবার্য পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে দলটিকে।  
 
সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন থেকে টানা ৯২ দিন ‘সহিংস’ আন্দোলনে কাক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপির জামায়াত বিরোধী অংশের নেতারা দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
 
এ অংশটি দলের হাইকমান্ডকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তত্ত্বাবধয়াক সরকার ইস্যুতে ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সিলেট অভিমুখে লংমার্চ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ এবং ওই বছর ১২ মার্চ ‘চলে চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি পর্যন্ত সরকার বিরোধী আন্দোলন সঠিক পথে ছিলো।
 
কিন্তু ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাত্রা শুরু করলে জামায়াতের ‘ভুল’ দিক নির্দেশনায় পথ হারায় বিএনপির আন্দোলন।
 
সূত্র জানায়, বিএনপির প্রগতিশীল অংশ মনে করে, দলের মূলধারার রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা কয়েকটি ভুইফোঁড় পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা খালেদা জিয়াকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন।
 
এদের মধ্যে স্বঘোষিত একজন সম্পাদক, জামায়াতপন্থি গুটিকয়েক সাংবাদিক, সুবিধাবাদী ক’জন শিক্ষক নেতা, ‘আদর্শচ্যুত-ধান্দাবাজ’ এনজিও মালিক এবং জামায়াতমুখী চৈনিক ‘বাম’ রয়েছেন। এরাই মূলত, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে জামায়াতি স্টাইলে পরিচালনার ব্যাপারে বিএনপি প্রধানকে উৎসাহী করেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণাজগরণ মঞ্চের প্রতি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন দেখে ভড়কে যায় বিএনপি। ফলে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করার প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে পূর্বঘোষিত ৯ ফেব্রুয়ারির জনসভা বাতিল করে তারা।
 
কিন্তু হঠাৎ করে বিএনপির ‘ত্রাণকর্তা’ হয়ে ওঠা স্বঘোষিত একজন দার্শনিক, একজন সম্পাদক, বিএনপির চেয়ারপারসনের দুই জন কর্মকর্তা এবং জামায়াতপন্থি কয়েকজন পেশাজীবী নেতা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হন, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে জামায়াতের কোনো বিকল্প নেই।

ফলে ১২ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে সমর্থন জানালেও ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে মওলানা ভাসানী মিলনায়তনে ঢাকা মহানগর বিএনপির এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখনো অটুট আছে।  
 
এই ঘোষণার পরপরই কোণঠাসা জামায়াত পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচির পরিবর্তে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাক দেয়। চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৪ শিবিরকর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই হরতাল-ই স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের প্রথম দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল।
 
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ‘তুঙ্গে’ থাকায় ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই হরতাল সফলতার মুখ না দেখলেও ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা চালায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা।
 
সূত্রমতে, প্রচণ্ড চাপে থাকার পরও জামায়াতের এই শক্তি প্রদর্শন বিএনপিকে পুলকিত করে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে জোট শরিক জামায়াতের এই শক্তিকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। এরই ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেই ২০১৩ সালের ১ মার্চ তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন খালেদা জিয়া। জামায়াত কর্মীদের ওপর ‘পুলিশি হামলার’ অভিযোগ তুলে ওই সংবাদ সম্মেলন থেকেই হরতালের ডাক দেন বিএনপি প্রধান।  
 
বিশ্লেষকদের মতে, ওই দিন থেকেই তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আন্দোলনে রূপ নেয়। বিএনপির তথাকথিত ‘অহিংস’ আন্দোলন জামায়াতের ছোঁয়ায় ‘সহিংস’ আন্দোলনে  মোড় নেয়।

সূত্রমতে, দলের অনেক নেতাই এখন মনে করেন, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, ফিসপ্লেট খুলে রেললাইন উফড়ে ফেলা, বিদ্যুৎ স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া, গাছ ও রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, ভাঙা কাঁচের বোতল বিছিয়ে সড়কে যান চলাচল বাধা দেওয়া, হাইওয়েতে ধাতব কাঁটা পুঁতে রেখে গাড়ির চাকা ফুটো করাসহ আন্দোলন কর্মসূচিতে নানা ধরনের বিভৎসপন্থা অবলম্বের দীক্ষা জামায়াতের কাছ থেকেই গ্রহণ করে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
 
অনেক সময় জামায়াতি স্টাইলে পেট্রোলবোমা ও ককটেল নিক্ষেপ করতে গিয়ে পুলিশ ও জনতার হাতে ধরা পড়ে গণধোলাইয়ের শিকার হওয়ায় বিএনপি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং জনরোষের ভয়ে জামায়াতের মতো বিএনপিকেও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়েছে বলে মনে করেন দলটির প্রগতিশীল অংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মুহূর্তে জামায়াতের যতো সংখ্যক নেতা-কর্মী কারাগারে আছেন, বিএনপির কারাবন্দি নেতা-কর্মীর সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়। জামায়াত যেমন প্রকাশ্যে রাস্তায় নামার সাহস পাচ্ছে না, বিএনপিও তেমনি প্রকাশ্যে রাস্তায় নামার সাহস দেখাচ্ছে না। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ভোট কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য পোলিং এজেন্টই খুঁজে পায়নি।
 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের স্টাইল ফলো করতে গিয়ে অনিবার্যভাবে জামায়াতের পরিণতিই এখন ভোগ করছে বিএনপি।
 
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হিসেবে আমরা আমাদের আইডলজি থেকে আমাদের স্টাইলে আন্দোলন করেছি, তারা (জামায়াত) তাদের আইডলজি থেকে তাদের স্টাইলে আন্দোলন করেছে।
 
আমরা অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করি। আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। কেউ যদি তাদের আইডলজি থেকে সহিংস আন্দোলন করতে চায়, সেক্ষেত্রে আমরা তাদের কাছ থেকে সরে আসবো। অথবা তাদেরকে সরিয়ে দেব- বলেন মাহবুবুর রহমান।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৫
এজেড/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।