ঢাকা: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলেও আইন সংশোধন জটিলতায় ঝুলে আছে দল বা সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ সংশোধন সংক্রান্ত একটি বিল দীর্ঘদিন ধরেই মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে।
কিন্তু মন্ত্রিসভা এখন পর্যন্ত আইনটির সংশোধনীর খসড়া অনুমোদন না দেওয়ায় তা সংসদেও উত্থাপিত হচ্ছে না। অথচ আইন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে খসড়া জমা দেওয়ার পর বেশ কয়েকটি অধিবেশন পার করেছে জাতীয় সংসদ।
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধী সংগঠন হিসেবে শুধু জামায়াতেরই নয়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও বিচার করতে চায়। এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা তুলে ধরতেও আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সংগঠনের বিচার এবং শাস্তির বিধান রেখে সংশোধিত আইনটি পাস হলে জামায়াতের পাশাপাশি অভিযুক্ত অন্যান্য দল বা সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে আর কোনো বাধাই থাকবে না। তেমনটা হলে শুধু জামায়াতই নয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে আরও একাধিক দল ও সংগঠনকেও। আর বিচারের সে তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী দল হিসেবে থাকতে পারে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ও কৃষক শ্রমিক পার্টি। আইনের সংশোধনীর খসড়ায় যুদ্ধাপরাধে জড়িত দল-সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান থাকায় ট্রাইব্যুনালের বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করার রায়ও আসতে পারে।
জামায়াত ছাড়া অপর পাঁচটি দলকে কোন প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ ব্যাপারে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
দলগুলোর মধ্যে জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম থাকলেও অপর পাঁচটি দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নামসর্বস্ব এসব দলের তৎপরতা মাঝে মধ্যে দেখা যায়। কার্যত, অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বেশিরভাগ দলের। এসব দলের নেতারা স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও অধিকাংশই পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে একীভুত হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ডিসেম্বরে যশোর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সে সময় জামায়াতের নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আযম, মুসলিম লীগের (কনভেনশন) নেতৃত্বে ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সবুর খান, মুসলিম লীগের (কাউন্সিল) নেতৃত্বে ছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন, পিডিপির নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল আমিন, নেজামে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আতাহার আলী ও মৌলভী ফরিদ আহমেদ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন এসএম সোলায়মান।
নাম ও পদবী গোপন রাখার শর্তে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আইসিটি আইন সংশোধনের খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত সংগঠনকে নিষিদ্ধ ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ায় বিদ্যমান আইনের ১০টি ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি ধারায় কেবলমাত্র ‘ব্যক্তি’ শব্দের পাশাপাশি ‘সংগঠন’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
খসড়ার ২০ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবেন। সংগঠনের নামে বা অন্য কোনো নামে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন। বিদ্যমান আইনের ২০ ধারায় কেবল ব্যক্তির সাজার বিধান রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ শেষ করে গত বছরের ২৭ মার্চ তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বিভাগে জমা দিয়েছেন। কিন্তু আইন সংশোধিত না হওয়ায় গত পনের মাস ধরে প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরির কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে ট্রাইব্যুনালে উঠছে না মামলাটি।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। কবে নাগাদ মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমিও অপেক্ষায় আছি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যকরী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যমান আইনেই জামায়াতসহ অভিযুক্ত দল, সংগঠনের বিচার এবং শাস্তি দেওয়া সম্ভব। বিদ্যমান আইনে সংগঠন হিসেবে বিচারের শাস্তির বিধান না থাকলেও ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তা নির্ধারণ করতে পারেন।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’র বিধান নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের বিচাররকরা মানবতাবিরোধী অপরাধে একাধিক ব্যক্তিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এতোদিনেও আইনটির সংশোধন না হওয়া খুবই দুঃখজনক মন্তব্য করে বাংলানিউজকে তিনি আরো বলেন, আইন সংশোধনে এত বিলম্বের কোনো কারণ দেখছি না।
শাহরিয়ার কবির বলেন, সংগঠন হিসেবে জামায়াতসহ অন্যান্য দলের বিচার না হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং ট্রাইব্যুনালও সম্পূর্ণ হবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই জামায়াতের বিচার হওয়া উচিৎ।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তের মতেও বিদ্যমান আইনে সংগঠনের বিচার এবং শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের আছে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সে অনুযায়ীই প্রসিকিউশন টিম প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন মামলাটি ট্রাইব্যুনালে তোলার জন্য। সে সময় সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। সরকার মনে করলে আইনটিকে আরো সুস্পষ্ট করতে সংশোধনের উদ্যোগ নিতেই পারে। কিন্তু এতো সময় কি কারণে লাগছে তা বলতে পারবো না।
তিনি বলেন, সরকার বিশেষ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের বিচারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি রক্ষা করেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই আমরা আশা করতে পারি, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতসহ অন্যন্য দল-সংগঠনের বিচার হবে।
তদন্ত সংস্থার দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ সাত ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে জামায়াত ও তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামায়াত, তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী ও আলশামস বাহিনীর নানা নৃশংস অপরাধ এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের যাবতীয় অপরাধের অভিযোগ তুলে আনা হয়েছে এ তদন্ত প্রতিবেদনে। জামায়াতের নীতিনির্ধারক, সংগঠক, পরিচালক এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এসব অপরাধের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
এসব অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী দল জামায়াত ও তার সব অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ, অবলুপ্ত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আরজি জানানো হয়েছে। একইভাবে জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির (সে সময়কার ইসলামী ছাত্রসংঘ) ও ইসলামী ছাত্রীসংস্থা, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আলশামস নিষিদ্ধ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত চাওয়া হয়েছে। অভিযোগ করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আরজি জানানো হয়েছে জামায়াতের বিভিন্ন সহযোগী ১২৭ প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের বিরুদ্ধেও। ভবিষ্যতেও যেন কেউ এ ধরনের রাজনীতির আলোকে রাজনৈতিক দল গঠন বা রাজনীতি করতে না পারেন সে রায়ও চাওয়া হয়েছে।
এর আগে নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ না করায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসাবে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ০১০২ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৫
এমএইচপি/এএসআর