ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

চাচা-ভাতিজার দখলোৎসব

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
চাচা-ভাতিজার দখলোৎসব এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়

মানিকগঞ্জ: দখলোৎসব চলছে মানিকগঞ্জে। আর এই দখলদারি নিয়ে অভিযোগের তীর ক্ষমতাসীন দলের এক এমপি ও তার চাচার দিকে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভাতিজা এমপি হওয়ায় তার আশকারা পেয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন চাচা। ভাতিজার ক্ষমতার জোরে চাচা এখন আর আইন-কানুনের ধার ধারেন না। সরকারি খাল-জমিই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের সম্পত্তি একে একে দখল করে নিচ্ছেন তিনি। মাথা গোঁজার ভিটে-বাড়ি হারিয়ে সেই সব নিরীহ মানুষ এখন পথে পথে ঘুরছেন।

ঢাকার পাশের মানিকগঞ্জ-১ (দৌলতপুর, ঘিওর ও শিবালয়) আসনে সরকারি দলের এই এমপি হলেন এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এমপির চাচা তায়েবুর রহমান টিপু মানিকগঞ্জে গড়ে তুলেছেন দখলবাজ বাহিনী। এই দলে রয়েছেন চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশা এবং চিহ্নিত ভূমিদস্যু আলমগীর আলমও। তারাই রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী কায়দায় সাধারণ মানুষের জমিজমা জবরদখল করছেন। দৌলতপুরে এই দখলবাজদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। টিপুর ভাতিজা এমপি হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

স্থানীয় সূত্র মতে, মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার মানুষের দিন-রাত কাটে অজানা আশঙ্কায়। যেকোনো সময় দখলবাজরা হানা দিতে পারে, দখল করে নিতে পারে সহায়-সম্পত্তি; এমন আশঙ্কায় রাতে পালাক্রমে পাহারাও চলে কোনো কোনো এলাকায়।

সরেজমিনে ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের অনেককেই রাত জেগে তাদের প্রতিষ্ঠান পাহারা দিতে দেখা গেছে। সংঘবদ্ধ দখলবাজদের ভয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকজন দোকানদার তাদের চারটি দোকান রক্ষায় পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। সন্ধ্যায় যেখানে ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সকালে সেখানে দেখা যায় খুঁটি আর নতুন টিনের চাল।

জানা গেছে, গত এক বছরে দৌলতপুর উপজেলা সদর বাজারে সরকারি জায়গা, নিরীহ লোকদের দোকান দখল করে পাকা ঘর ও একাধিক বিশাল পাকা মার্কেট নির্মাণ করেছে সংঘবদ্ধ এই দখলবাজ চক্র। কেউ প্রতিবাদ করলেও ‘এমপির নির্দেশ আছে’ বলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না।

সূত্র জানায়, দখল করা এসব জায়গা লিজ দেওয়ার নামেও চলছে বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, সেই অর্থের সিংহভাগ জমা করতে হয় এমপির কোষাগারে।

সূত্র মতে, এমপির চাচা টিপুর নির্দেশে মো. মোশারফ হোসেন মুশা ও ভিপি আলমগীর হোসেন আলমের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ দখলবাজরা গত ১২ নভেম্বর রাতের আঁধারে দৌলতপুর বাজারের পশ্চিম পাশে সরকারি জায়গা দখল করে ১২টি ছাপড়া ঘর তোলে। সম্প্রতি রাতে ট্রাকে করে মাটি এনে দৌলতপুর বাজারের পূর্বপাশে ১ নম্বর খতিয়ানের ৪৬৮ দাগের প্রায় ৩৫ শতাংশ সরকারি খাল ভরাটের কাজ শুরু করে। পরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়।

স্থানীয় লোকজন জানান, দখলের এই নেপথ্যে ছিলেন এমপি দুর্জয় নিজেই।

জানা যায়, উপজেলার জিয়নপুর গ্রামের লোকমান দেওয়ান ও মোহাম্মদ আলী দেওয়ানের সঙ্গে দৌলতপুর বাজারে রামচন্দ্রপুর মৌজার ২১ নং দাগের ১৬ শতাংশ জমি ও দোকানঘর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল এমপির এক আত্মীয়র। এই বিরোধপূর্ণ দোকানঘরসহ জমি নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষকে স্থিতাবস্থা বজায় থাকার নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু এমপির ওই আত্মীয় ভূমিদস্যু ভিপি আলমগীর হোসেন আলমকে জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে দিলে তিনি ২৩ নভেম্বর রাতে ঘর ও জায়গা দখল করে নেন। ওই সময় লোকমান দেওয়ান ও মোহাম্মদ আলী দেওয়ান বাধা দিলে আলমগীর হোসেন আলমের ক্যাডার বাহিনী ও পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে। এতে ১০ জন মারাত্মক আহত হন। এরপর থেকে আলম বাহিনীর ভয়ে তটস্থ এলাকাবাসী। এমপির নির্দেশে তার আত্মীয় আলমগীরকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।

এদিকে সরকারি খাল ভরাটের পর মার্কেট নির্মাণ করে পজিশন দেওয়ার নামে অর্থ নেওয়া হলেও তা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এমপি দুর্জয়ের নির্দেশে সরকারি খাল ভরাট করা হয়। যাদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয় তারা হলেন-জৈন্তা গ্রামের মো. আমিনুর রহমান, সমেতপুর গ্রামের জুলফিকার হোসেন, মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ারা দোলেন, তার বোনজামাই চান্দু মিয়া, ছোট বোন স্কুলশিক্ষিকা খুদেজা বেগম, কাকা আজাদ হোসেন, আলতাফ হোসেন, শহিদুল ইসলাম শহিদ, আমোদ আলী, আবদুল হালিম, শুবোত মিয়াসহ আরো ১০-১৫ জন। তাদের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব টাকা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ও ভিপি আলমগীর হোসেন আলম উঠিয়ে এমপির চাচা তায়েবুর রহমান টিপুর হাতে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। টাকা ফেরত চাওয়ায় ভুক্তভোগীদের নানা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশা ও আলমগীর হোসেন আলম।

দৌলতপুর বাজারের টিন ব্যবসায়ী মো. জুলফিকার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, সমেতপুর রোডে সরকারি জায়গা পজিশন দেওয়ার কথা বলে চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মুশা তার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছেন। এভাবে আরো ১০-১৫ জনের কাছ থেকে নগদ চার-পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘সবাই রাতের আঁধারে ঘর তুলেছে। আমাকে যে জায়গায় পজিশন দেওয়ার কথা, সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের কামারদের দোকান ওঠানো আছে। তাই আমি তাদের সঙ্গে বিরোধ করে জায়গা নেবো না। জায়গা না পেলে টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চাইবো। ’

মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ারা দোলেন বলেন, ‘আমি ঢাকায় ছিলাম। এমপি সাহেবের নির্দেশে আমি আমার কাকার মাধ্যমে চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশার কাছে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখন গড়িমসি করছে। ’

আরেক ভুক্তভোগী আবদুল হালিম বলেন, ‘চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশার কাছে নগদ পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। আমাকে ঘরের জায়গা না দিলে টাকা ফেরত দিতে বলেছি। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিপি আলমগীর হোসেন আলম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দোকান দখল, সমেতপুর রোডে সরকারি জায়গা দখল, তিনটি দোকান উত্তোলন, গ্রামের ভেতর হিন্দুপাড়ায় জলপাইতলায় সরকারি আট শতাংশ জায়গা দখল, কলেজগেট এলাকায় সরকারি রাস্তা ঘেঁষে দোকান উত্তোলনের অনেক সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে! আমার বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় সাংবাদিক লিখেছে, কিছুই করতে পারেনি। ’

খাল ভরাট প্রসঙ্গে আলমগীর হোসেন আলম বলেন, ‘খালে মাটি ভরাটের জন্য এমপি ও তার চাচা টিপু এবং চেয়ারম্যান আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরে ইউএনওর নির্দেশে মাটি ফেলা বন্ধ রাখি। ’

সদর চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশা সাংবাদিকদের জানান, এমপি সাহেবের নির্দেশে সরকারি খালে মাটি ভরাট শুরু করা হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খালে মাটি ভরাটকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্থ-বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের দোকানের পজিশনের জন্য অফিস খরচ ও খালে মাটি ভরাটের জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে।

আতঙ্কিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়: সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু মদন কুমার দাস, লক্ষণ কুমার দাস, বরদ কুমার দাস স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের লোকজন নিয়ে দখলবাজদের ভয়ে রাত জেগে দোকানঘর পাহারা দিচ্ছেন। তারা জানান, দীর্ঘ ১৫-২০ বছর ধরে এখানে দোকানঘর তুলে ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন উপার্জন করে কোনোমতে ছেলেমেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিছুদিন ধরে থানার ‘বড় স্যার’, চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মুশা ও ভিপি আলমের নেতৃত্বে তাদের ক্যাডার বাহিনী প্রতিদিন ঘর ও জায়গা দখলের হুমকি দিয়ে আসছে। তাই কয়েক মাস যাবৎ পরিবারের লোকজন, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রাত জেগে দোকানঘর পাহারা দিচ্ছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউর রহমান বলেন, ‘এমপি স্যারের নির্দেশে সদর চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন মুশা দুই মাস আগে ট্রাকে করে মাটি এনে দৌলতপুর বাজারের পূর্ব পাশে ১ নম্বর খতিয়ানের ৪৬৮ নম্বর দাগের সরকারি খাল ভরাট করছিলেন। পরে ডিসি স্যারের নির্দেশে মাটি ভরাটকাজ বন্ধ করে দিই। ’

অর্থ-বাণিজ্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘দোকানের পজিশন দেওয়ার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সরকারি খাল ভরাট করে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। ’

সরকারি জায়গা লিজ দিয়েছেন কি-না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি কাউকে লিজ দিইনি’। তিনি আরো বলেন, ‘আমি ছুটিতে থাকায় গত ১২ নভেম্বর রাতে সরকারি জায়গায় দখলবাজচক্র ১২টি ছাপরাঘর তোলে। ’ এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমপি স্যার জড়িত, আমি ডিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ’

জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস জানান, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে জবরদখল করলে সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে সরকারি বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।