সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি বাসই ছাত্রলীগের কোনো না কোনো নেতার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাস মালিকরা তাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে চান না বলে বিশ্বাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তারা কোনো অভিযোগও করেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৭ ডিসেম্বর ঠিকানা পরিবহনের ছয়টি বাস আটক করেন জাবি আল বেরুনী হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আটকের পর তারা মালিকের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন।
পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর বিকেলেও এম এম লাভলি পরিবহনের তিনটি বাস আটক করেন শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারা ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক হাসানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পরে ছাত্রলীগ কর্মী লায়েব আলীর মধ্যস্থতায় বিষয়টি সমঝোতা হয়।
ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী প্রত্যেকটি পরিবহনের দায়িত্বে রয়েছেন কোনো না কোনো ছাত্রলীগ নেতা। জুয়েল-চঞ্চল কমিটি গঠনের পর ২০১৭ সালে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের নেতাদের মধ্যে বাস ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়।
সেই সময় অন্যান্য নেতাদের বাদ দিয়ে সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান চঞ্চল তিনটি বাসের দেখাশোনা করতেন। তিনি গত ৩১ আগস্ট ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে বাসের দখলদারিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা প্রকাশ্যে চলে আসে। দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই বাস আটক করে রাখছেন নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী বলেন, প্রায়ই নানা অজুহাতে বাস আটকে রাখে ছাত্রলীগের নেতারা। এতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে মনে হয় তারা যেন বাস দেখাভালের দায়িত্বে নিয়োজিত, যেন ‘বাস অ্যাম্বাসেডর’।
বাস মালিক কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী ওয়েলকাম, ইতিহাস ও রাজধানী পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা।
অগ্রদূত পরিবহন থেকে সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক হাসান, সাভার পরিবহন থেকে উপ তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল হাসান শাওন, ঠিকানা পরিবহন থেকে উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ইসমাইল হোসেন ও উপ-ছাত্র বৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, এম এম লাভলি ও লাব্বাইক পরিবহন থেকে মীর মশাররফ হোসেন হলের পদপ্রার্থী লায়েব আলী নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন।
এছাড়া আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে চলাচলকারী বাসগুলো থেকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকা সভাপতি ও সম্পাদককে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন একাধিক ছাত্রলীগ নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি পরিবহনের আঞ্চলিক ম্যানেজার বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাস ভেদে প্রতিটি পরিবহনের জন্য প্রতি মাসে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে দিতে হয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের। তাদের টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে বাস আটকে রাখা ও ভাঙচুরসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব হয়রানি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই তাদের টাকা দিতে হয়। ’
তবে চাঁদা গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করে ছাত্রলীগ কর্মী লায়েব আলী বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে যে গাড়িগুলো চলে প্রত্যেকটা গাড়িই কোনো না কোনো নেতা দেখভাল করেন। এম এম লাভলির এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আমার পরিচিত। তাই তাদের গাড়ি কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে জানায়। ’
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিজানুর রহমান ও রাকিবুল হাসান শাওনও। তারা বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। তারা (বাস কর্তৃপক্ষ) একবার ঝামেলায় পড়ে ফোন দিয়েছিলো। এর বেশি কিছু না। ’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বাস মালিকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো অভিযোগের বিষয়ে আমি জানি না। ’
তিনি বলেন, ‘যদি লেনদেনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সেটার জন্য বাস মালিকরাই দায়ী। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ঝামেলায় জড়ায়। পরে সেটা সমাধানের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছে আসে। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাস মালিকরা আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ দেননি। তারা যেকোনো বিপদে পড়লে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় তৃতীয় পক্ষ এই সুবিধাটা নেয়। আর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাস কর্তৃপক্ষের অশোভন আচরণ করা ত্যাগ করতে হবে। অশোভন আচরণের সূত্র ধরেই মূলত এই ঝামেলাগুলো হয়ে থাকে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯
এমএ/এজে