ঢাকা: জাতীয় স্বার্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য ইলেকশন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনে একটি জাতীয় কমিশন করা দকার বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি এবং দেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছাত্রজীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দরকার হবে নতুন কমিশন গঠন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে বাকি এখনো দুই বছরের বেশি। ২০২৩ সালের শেষদিকে এ নির্বাচন হতে পারে। এরই মধ্যে এ দুই ইস্যুতে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা এবং পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। কোন প্রক্রিয়ায় কাদের নিয়ে নতুন ইসি গঠন হবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরব।
এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে উল্লেখিত কথা বলেন। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন যে প্রক্রিয়ায় হয়, দলীয় সরকার থাকলে এটা খুব কঠিন। বরঞ্চ সরকারের পক্ষে প্রভাবিত নির্বাচন কমিশন গঠন করা অনেকটাই সহজ। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে একটা কমিশন হওয়া উচিত, যারা নির্ধারণ করবে, দেশের সেরা নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বদের। বিচার বিভাগকে যুক্ত করে এরকম একটা কমিশন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র লড়াই করে ক্ষমতাসীন হয়েছে। পরবর্তীকালে সুপ্রিমকোর্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর প্রয়োজন নেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবার বিএনপি যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানতো না, তারাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত আর কিছুই দেখছেন না। কিন্তু কথা হচ্ছে এই সরকার বানাবে কে? বরঞ্চ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি জাতীয় কমিশন করা দরকার, বিচারপতিসহ জাতির বিবেক বলে খ্যাত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে। এমন কমিশন গঠন করা খুব কঠিন কিছু নয়। বিবেকবান এবং মানবিকতা সম্পূর্ণ মানুষদের বাছাই করে কমিশন গঠনের জন্য কার্যক্রম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানিয়ে, আবার ক্ষমতায় গিয়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে চিরতরে নাকচ করে দেওয়া হবে এই রেওয়াজগুলো খুবই দুঃখজনক। এখন পর্যন্ত আমরা প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক কতগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের বিচার বিভাগ এখন পর্যন্ত জন আকাঙ্ক্ষিত সংস্থা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে অসমর্থ হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ যে সরকার থাকে তার অনুগতই থাকে। এদিক থেকেও একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি হয়নি। গড়ে ওঠেনি মানবাধিকার কমিশন, যেগুলো আমাদের পথ দেখাবে, গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে।
জাতীয় কমিশন কেমন হবে জানতে চাইলে দেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, একটা জাতীয় কমিশন, যেটা হবে সর্বোচ্চ কমিশন। এখানে দেশের বিবেকবান ব্যক্তিরা থাকবেন। তারাই বিচার বিভাগকে যুক্ত করে নির্ধারণ করবেন একটা স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা। তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনে যারা জয়ী হবে তারাই ক্ষমতাসীন হবে। পরাজিতরা ক্ষমতার বাইরে থেকে আরেকটা নির্বাচনে নিরপেক্ষতার সুযোগ পাবে। এটা না করে রক্তারক্তি, আন্দোলন, গাড়ি-ঘোড়া পোড়ানো, জানমালের ক্ষতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা হিসেবে আর কতোবার দেখা উচিত? এটা নিয়ে আমরা খুবই বিব্রত বোধ করি।
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি বলেন, যে অবস্থায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা চলে এসেছে, তাতে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আর আছে বলে আমার মনে হয় না। সাধারণ মানুষের নির্বাচনের প্রতি অনীহা এবং অনাস্থা দেখা দিয়েছে। এই অনীহা এবং অনাস্থা দূর করতে হবে। মানুষের মধ্যে নির্বাচন বিষয়ে আবার আশাবাদ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের সংবিধানে বর্ণিত আছে, জনগণ ক্ষমতার মালিক। জনগণের সার্বভৌমত্ব নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হতে হবে। যেটা এখন হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই দেশে এত অস্থিরতা। এছাড়াও আরেকটা ভয় কাজ করে ক্ষমতা থেকে চলে গেলে আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারবো কিনা।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের দেশ, মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ। আবার রাজাকারেরও দেশ। এখানে বিরোধী দলকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। সরকারি দল এবং বিরোধী দল উভয়ের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতা, তা সুযোগ করে দিয়েছে এককভাবে ক্ষমতায় থাকার। জনগণের মধ্যে যেই ব্যবস্থা কোনো উৎসাহ সৃষ্টি করে না, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আরও উন্নত কোনো ব্যবস্থা রয়েছে কিনা তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হওয়া দরকার এবং স্থির করা দরকার মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না করে, আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যেন কোনও বিতর্ক তৈরি না হয়।
তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও হচ্ছে। সেখানে স্থানীয় এবং রাজ্যগুলোর নির্বাচন এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে, তারা রায়ও মেনে নিচ্ছেন। সেইখানে আমরা ৫০ বছরেও পৌঁছাতে পারবো না এটা কোন যুক্তিসংগত কথা হতে পারে না। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার। দরকার হলে সেই ব্যবস্থায় যারা যুক্ত হবেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত করে দিয়ে তারা ওয়াচ ডগ হিসেবে থাকবেন এমন একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। না হলে প্রতিবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠবে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যেও নানা রকম গোঁজামিল এবং দলবাজি থাকতে পারে। এর চেয়ে একটা স্থায়ী নির্বাচনী ব্যবস্থা দরকার, সাংবিধানিকভাবে তারা যেন নির্বাচনকে যেকোনোও ধরনের হস্তক্ষেপমুক্ত করতে পারে। বিচার বিভাগ যেমন স্বাধীন, তেমন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা দরকার।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২১
আরকেআর/এনটি