রাজশাহী: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে সম্প্রতি বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। পরে তাকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এবার বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্যের অডিও ফাঁস হওয়ায় আলোচনায় এসেছেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী।
এরই মধ্যে তাকে কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিলসহ আজীবনের জন্য বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। ফলে মেয়র জাহাঙ্গীরের মতো আব্বাসের পরিণতি একই হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীরকে ১৯ নভেম্বর দল থেকে বহিষ্কার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জাহাঙ্গীর ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডলকে সেখানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানানো হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
এদিকে, অবমাননাকর বক্তব্যের পর বিতর্কের ঝড় ওঠায় ইতোমধ্যে কাটাখালি পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ থেকে তাকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করতে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। আর মেয়রের পদ থেকে তার অপসারণ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছেন পৌরসভার ১২ জন কাউন্সিলর। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
মেয়র আব্বাস আলী একটি ঘরোয়া বৈঠকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের কাটাখালী পৌরসভার অংশের উন্নয়নকাজ নিয়ে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে কটূক্তি করেন। ২২ নভেম্বর রাত থেকে মেয়র আব্বাসের এমন দুটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারে। ওই অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁসের পর তিনিও ফেঁসে যান।
যা বলেছিলেন মেয়র আব্বাস
অডিওতে মেয়র বলেন, ‘একটু থাইমি গেছি গেটটা নিয়ে, একটু ডিজাইন চেঞ্জ করতে হচ্ছে। বড় হুজুরের সঙ্গে আমাদের এক লোক বসেছিলে, বসি যে ম্যুরালটা দিছে বঙ্গবন্ধুর, এটা ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক সঠিক না। এজন্য আমি ওকে থুব না। সব করব, যা কিছু আছে, খালি শেষ মাথাতে মানুষ যেটা মাইন্ড করবে না ওড্যাই। আমি দেখতে পাছি যে, ম্যুরালটি ঠিক হবে না দিলে। আমার পাপ হবে। তো কেন দিব? দিব না, আমি তো কানা লোক না, আমাক বুঝাই দিছে। এজন্য আমি ওটাকে চেঞ্জ করছি। '
১ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপটিতে মেয়র আব্বাসকে বলতে শোনা যায়, ‘ওই গেটটি দ্রুত নির্মাণ হবে। তবে আমরা যে ফার্মকে কাজটি দিয়েছি, তারা গেটের ওপরে বঙ্গববন্ধুর যে ম্যুরাল বসানোর ডিজাইন দিয়েছে, সেটি ইসলামি দৃষ্টিতে সঠিক না। তাই আমি সেটিকে বাদ দিতে বলেছি। ’
মেয়র বলেন, ‘যেভাবে বুঝাছে তাতে আমার মুনে হইছে যে, ম্যুরালটা হইলে আমার ভুল হয়্যা যাবে। এজন্য চেঞ্জ করছি। এই খবরটাও যদি আবার যায় তো আবার রাজনীতি শুরু হয়ে যাবে। ওই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল দিতে চাইয়া দিচ্ছে না! বঙ্গবন্ধুক খুশি করতে যাইয়া নারাজ করব নাকি? এইডা লিয়েও রাজনীতি করবে কিন্তু আমি সিওর। ’
অডিও ফাঁসের পর যা হলো
অডিও ফাঁস হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী। দাবি উঠেছে গাজীপুরের মেয়রের মতো মেয়র আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা তাকে দলীয় ও মেয়র পদ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করছেন।
২৪ নভেম্বর সকাল থেকেই মহানগর এবং কাটাখালী পৌর এলাকায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে মেয়র আব্বাসের বিরুদ্ধে আইনগগত ব্যবস্থা গ্রহণ, তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির হুমকি দেওয়া হয়।
একই দিন নিজ পৌর এলাকা কাটাখালীতেও মেয়র আব্বাসকে বহিষ্কার ও গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সাবেক ছাত্রলীগ ফোরাম নামের একটি সংগঠন আব্বাস আলীর কুশপুতুল দাহ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। এরপর মেয়র আব্বাস আলীকে গ্রেফতার ও দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের দাবি জানায় মহানগর আওয়ামী লীগ।
২৫ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে ‘খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মা’ বলে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মা আব্বাস আলীর এমন ঘৃণ্য মন্তব্য দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। এটি রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করাসহ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও আওয়ামী লীগের ঐক্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টার অংশও বলেও মন্তব্য করেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা
অডিও ফাঁস হওয়ার পরদিন ২৩ নভেম্বর আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মহানগরীর বোয়ালিয়া, রাজপাড়া ও চন্দ্রিমা থানায় মামলার এজাহার দায়ের করা হয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমোদন সাপক্ষে ২৪ নভেম্বর বোয়ালিয়া থানার মামলাটি কেবল গ্রহণ করা হয়।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুল মোমিন বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের করেন। বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহাবুল আলমকে তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন রাজপাড়া থানায় এবং মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন চন্দ্রিমা থানায় এজাহার দিয়েছেন। সদর দপ্তরের সিদ্ধান্তের জন্য মামলা দু'টি বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রাজশাহীর পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাজদার রহমান সরকার বাংলানিউজকে বলেন, গত ২৪ নভেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলীর সভাপতিত্বে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আব্বাস আলীকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সবশেষ ২৬ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে মেয়র আব্বাস আলীকে বহিষ্কার করতে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। এছাড়া তাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে কেন্দ্রে সুপারিশ করা হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম। তিনি আমাদের আবেগের স্থান। আব্বাস আলী যে মন্তব্য করেছেন সেটি চরমভাবে নিন্দনীয়। সভায় উপস্থিত নেতারা সর্বসম্মতভাবে আব্বাসকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য মতামত দিয়েছেন।
অপসারণ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি
এদিকে, আব্বাস আলী কাটাখালি পৌরসভার মেয়রের পদ হারাচ্ছেন বলেও গুঞ্জন উঠেছে। তার অপসারণ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছেন কাটাখালী পৌরসভার ১২ জন কাউন্সিলর। ২৫ নভেম্বর দুপুরে জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলোয় এই চিঠি দেওয়া হয়। পরে শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) পৌরসভার কাউন্সিলর সংবাদ সম্মেলন করে আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করে তার অপসারণ দাবি করেন।
চিঠি নেওয়ার পর রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিল বলেন, কাটাখালী পৌরসভা কাউন্সিলরদের চিঠিটি পেয়েছি। পরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড থেকে দলীয় পদ হারালে গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের মতো দলীয় মনোনয়নে মেয়র হওয়া আব্বাসও প্রাতিষ্ঠানিক পদ হারাবেন। শোনা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী কোনো কারণে পৌর মেয়র সাময়িক বরখাস্ত হলে সাংবিধানিকভাবে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পেতে পারেন পৌরসভার ১ নম্বর প্যানেল মেয়র আনোয়ার সাদাত।
এদিকে, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় রাসিক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহীকে আধুনিক তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নগরীর মূল প্রবেশদ্বারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপনের পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালকে নিয়ে আব্বাস আলীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ অবমাননাকর মন্তব্য জাতি সমর্থন করে না।
তিনি আরও বলেন, আব্বাস আলীর কটূক্তি ও অবমাননাকর মন্তব্যে সারা দেশের মানুষের ন্যায় আমরা চরমভাবে মর্মাহত। তার ধৃষ্টতাপূর্ণ অশালীন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সংগঠনের পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে আজীবন বহিষ্কারের পাশাপাশি গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
আব্বাস আলী রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবার পৌরসভা মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
এসএস/জেএইচটি