ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

কোন্দলে ভুগছে ফরিদপুর বিএনপি

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২২
কোন্দলে ভুগছে ফরিদপুর বিএনপি

ফরিদপুর: কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার দীর্ঘদিন পর আজও বিএনপির ফরিদপুর জেলায় পূর্ণাঙ্গ বা আহ্বায়ক কমিটি হয়নি। দলীয় কার্যক্রম চলছে অনেকটা নেতৃত্বহীনভাবেই।

নেতাদের কোন্দলে এমনিতেই জর্জরিত দলটি। তার ওপর দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় সাংগঠনিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে ফরিদপুর জেলা বিএনপি। এমন অবস্থায় জেলা বিএনপির কর্মকাণ্ডে নেমে এসেছে স্থবিরতা। দলের পুরনো কোন্দলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উপসর্গ। ফলে রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছেন ছন্নছাড়া তৃণমূল নেতারা।

স্থানীয় নেতারা জানান, ২০১৯ যখন ফরিদপুর জেলা বিএনপির যে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়, সেই কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সভা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ওই সভার আগের রাতে জেলা বিএনপির দু'পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে তিনি ওই সভা বাতিল করে দেন। পরে জেলা বিএনপির নেতাদের নিয়ে ঢাকায় সভা হয়। কিন্তু মাঝপথে দু'পক্ষের রেষারেষিতে সভার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে জেলা বিএনপির সব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। একটি অংশ জেলা বিএনপির ব্যানারে অন্য অংশ সদর উপজেলা ও শহর বিএনপির ব্যানারে কর্মসূচি পালন করছে। এতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। তারা বলেছেন, যেখানে দলীয় প্রধান অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে সেখানে জেলা বিএনপির নেতাদের মধ্যে বিরোধ থাকাটা কাম্য নয়।

দুটি শক্তিশালী বলয়ে বিভক্ত সংগঠন: ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ফরিদপুরে বিএনপির রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী ও দলের সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান গ্রুপে নেতৃত্ব আছেন শামা ওবায়েদ, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মদাররেস আলী ঈসা। আর প্রয়াত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ গ্রুপে রয়েছেন শাহজাদা মিয়া, বিএনপির নির্বাহী কমিটির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল ও চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ কন্যা চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। এ দুই গ্রুপের বিরোধ ও দ্বন্দ্বে স্থানীয় নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত। তাই জেলাটিতে কর্মসূচিও পালিত হয় দুইভাবে।

তবে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য মির্জা আব্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর বিএনপির বিরোধ মীমাংসা করে দুই গ্রুপের সমন্বয় করে একটা শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে।

তিনি বিবাদমান সব পক্ষের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলেছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে শিগগিরই তিনি একটি কমিটি দেবেন বলে দলীয় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

স্থানীয় নেতারা আরও জানান, ওই দুই নেতার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে কেন্দ্রীয় টিমকে। কমিটিতে দু'পক্ষ থেকে ‘মাইম্যান’ ঢুকাতে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। জেলা কমিটি না থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক তৎপরতা।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জেলা বিএনপিতে যারা দীর্ঘদিন পদ-পদবি নিয়ে ছিলেন তারা তৃণমূলের সাধারণ নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর নেন না। নেতাদের পারস্পরিক গ্রুপিংয়ের কারণে জেলা কমিটি হয় না সময়মতো। করোনা ভাইরাসের কারণে জেলায় দলের পক্ষ থেকে জোরালো ত্রাণ তৎপরতা চালানো হয়নি। যেটুকু হয়েছে সেটি বিলুপ্ত কমিটির নেতারা ব্যক্তিগতভাবেই করেছেন। বিগত দিনে যারা রাজপথে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে নানা ঝামেলার মধ্যে পড়েছিলেন তাদের প্রতি কোনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি নেতারা। ফলে অনেকেই ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে দলের কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা উভয়ই বিএনপি করি। আমাদের মতের কোনো পার্থক্য নেই। কারো প্রতি কোনো ঈর্ষাও নেই। যেহেতু, ফরিদপুরে দীর্ঘদিন বিএনপির কমিটি নেই। সেজন্য দলের মধ্যে একটু টানাপোড়েন থাকতে পারে। তবে, নতুন কমিটি হলে এই বিভেদ আর থাকবে না।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুরে কমিটি না থাকার কারণে কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তবে, কমিটি হলে এটা থাকতো না।   অনেক আগেই কমিটি হওয়ার দরকার ছিল। এছাড়া ফরিদপুরে নতুন পদ-পদবি পাওয়ার একটা প্রতিযোগিতাও চলছে। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি নেই।

তিনি বলেন, নতুন কমিটি হলে এই সমস্যাটা আর থাকবে না।

জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী নায়েবা ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুর বিএনপিতে আমাদের কোনো বিভক্তি নেই। কিন্তু মনের কষ্ট আছে। বিষয়টি তিনি খোলাসা করে বলেন, যেহেতু তিনি (শামা ওবায়েদ) আমার সিনিয়র নেত্রী এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের সাংগঠনিক সম্পাদক সেহেতু সংগঠন ও নেতাকর্মীদের ধরে রাখার দায়িত্ব তার ওপর বত্যয়। আমি রাজনীতিতে তার অনুজ আর তিনি আমার অগ্রজ তাই আমাকে ডেকে নিয়ে কাছে নেওয়ার দায়িত্বও তার। যেহেতু তিনি আমাকে ডাকেনি তাই তার কাছে আমার আর যাওয়া হয়নি। তবে, তিনি ডাকলে আমি যাবো, রাজনীতিতে আমাদের কোনো বিভেদ নেই।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোদারেস আলী ইছা বাংলানিউজকে বলেন, জেলা বিএনপি ও পৌর বিএনপি আলাদা-আলাদা প্রোগ্রাম করে বলে দলের ভেতর বিভক্তি আছে এমনটা বলা যাবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট মোদারেস আলী ইছা বলেন, এভাবে আলাদা-আলাদাভাবে দলীয় প্রোগ্রাম করাতে কিছুটা বিব্রত হওয়ারই কথা। তবে, সমাধানের চেষ্টা চলছে। আশা করি দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে।

ফরিদপুরের প্রবীণ বিএনপি নেতা ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য আতাউর রশিদ বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতিতে মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান ও মরহুম চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ তারা যেভাবে রাজনীতি করছেন দল এবং নেতাকর্মীদের যেভাবে ধরে রেখেছেন তাদের শূন্যতা জেলায় বিরাজ করছে। তাদের রাজনৈতিক উত্তরসূরি শামা ওবায়েদ ও নায়েবা ইউসুফের মধ্যে সাংগঠনিক গঠনমূলক তৎপরতার বিশাল ফারাক। তবে শামা এবং নায়েবার সঙ্গে রাজনীতি করার পারিবারিক সম্পর্ক করে দিলেই ফরিদপুরে বিএনপির দলীয় সংগঠনের তৎপরতা আরও বাড়বে।

ফরিদপুর জেলা বিএনপি নেতা ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আবজাল হোসেন খাঁন পলাশ বাংলানিউজকে বলেন, নিজেদের ভেতর একটু কম্বাইন্ড সমস্যা আছে। তবে উভয় আন্তরিক হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেন জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, কতিপয় ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য দলের মধ্যে কিছুটা গ্রুপিং করছেন।

বিএনপি নেতা ও জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একেএম কিবরিয়া স্বপন বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ফরিদপুরে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকার কারণে সাংগঠনিকভাবে দলে কিছুটা দুর্বলতা আছে। তবে, এক সঙ্গে সভা-সমাবেশ করতে পারলে দল আরও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতো। তবে অচিরেই এ সমস্যা কেটে যাবে।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির সাবেক অর্থবিষয়ক সম্পাদক এবি সিদ্দিকী মিতুল বাংলানিউজকে বলেন, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা বিএনপির যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণেই দলের মধ্যে এখনো গ্রুপিং রয়েছে। আমরা যারা তৃণমূলের রাজনীতি করি আমাদের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। এ অঞ্চলের সিনিয়র নেতারা নিজেদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিলে কোনো গ্রুপিং থাকবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২২
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।