ঢাকা: বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
মঙ্গলবার (৩১ মে) রাজধানীর হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গণসংহতি আন্দোলন ও বিএনপির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে ঐকমত্য হয় এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম ৭টি জরুরি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা অবিলম্বে বদল হওয়া দরকার। এ বাস্তবতা বদল করতে হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমরা সমূহ বিপদের মধ্যে পড়বো। বর্তমান সরকার যেহেতু জনগণের ভোট ও সম্মতি ছাড়া জবরদস্তি করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি নিজেদের পকেটে ঢুকিয়ে জনগণের ওপর স্টিম রোলার চাপিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আন্দোলন ছাড়া আমরা মনে করি এই অবস্থা বদলানোর কোনো পথ নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের দলের দিক থেকে স্পষ্ট করে অবস্থান নিয়েছি। একটা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হতে পারে গণতন্ত্রের গতিমুখে ফেরার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এবং এই নির্বাচন হতে হলে জনগণ সত্যিকার অর্থে ভোট দিতে পারবে—এমন একটা নির্বাচন করতে হলে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। বিশেষভাবে ২০১৮ সালের রাতের অন্ধকারের ভোটডাকতির পর এ সরকারের অধীনে আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে— বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশে ন্যূনতম কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণসংহতি আন্দোলন উত্থাপিত ৭টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হয়। পয়েন্টগুলি হলো:
১. আইন বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য স্বচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি এবং জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন না করার কঠোর নীতিমালা প্রনয়ণ। নিম্ন আদালতের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ সার্বিক কার্যক্রম তদারকির ক্ষমতা উচ্চ আদালতের অধীনস্ত করা। সকল গণবিরোধী, নাগরিক অধিকার খর্বকারী, উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সৃষ্ট আইন যা এখনো বলবৎ আছে সেসব আইন বাতিল করে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বাধীন দেশের উপযোগী আইনকানুন ও আইনি কাঠামো তৈরি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য আইন প্রণয়ন।
২. সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, মহা হিসাব-নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদিতে সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পদ্ধতি প্রনয়ণের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গঠিত সংসদের সরকারীদল, বিরোধীদল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের দ্বারা এই কমিশন গঠিত হবে।
৩. রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট বিধান প্রণয়ন। সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার।
৪. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন। নির্বাচনে প্রতিন্দন্দ্বিতা ও প্রচারণায় টাকার খেলা, পেশী শক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ব্যবহারের পথ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় আইনী সংস্কার।
৫. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে সংসদ সদস্যদের (কেবলমাত্র সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাশে ভোট প্রদান ব্যাতিরেকে) স্বাধীনভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সকল বিলে ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করা। সরকার ও দলের ক্ষমতাকে পৃথকীকরণে আইন প্রনয়ণ।
৬. বিদ্যমান সংবিধানের ‘স্থানীয় শাসন’ ব্যবস্থার বদলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সকল উন্নয়ন কর্মাণ্ড, আইন শৃক্ষলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক সেবা এবং এর প্রয়োজনীয় বাজেট প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার।
৭. দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনী বিধান। জাতীয় সম্পদ ব্যবহার ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যতীত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে আলোচনা বাধ্যতামূলক করা। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আইনী সুরক্ষা এবং ধর্ম, বর্ণ, জাতি ভাষা ও লিঙ্গীয় পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জীবন , সম্পদ ও মর্যাদার নিরাপত্তা বিধান।
বৈঠকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জননেতা জোনায়েদ সাকি, নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখ্তার, হাসান মারুফ রুমী, মনির উদ্দীন পাপ্পু, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূঁইয়া, জুলহাসনাইন বাবু, ইমরাদ জুলকারনাইন ইমন, দীপক রায়, কেন্দ্রীয় সদস্য আলিফ দেওয়ান, মিজানুর রহমান মোল্লা, জাতীয় পরিষদের সদস্য ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক মনিরুল হুদা বাবন।
বিএনপির প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও জহির উদ্দিন স্বপন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২২
এমজেএফ