ঢাকা: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেজ্ঞার কী কী প্রভাব রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর পড়বে বা এর প্রভাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা এসব প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। গত ১১ মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রভাব এখন রূপপুর প্রকল্পেও পড়তে শুরু করেছে।
সম্প্রতি এ প্রকল্পের পণ্য নামাতে না পেরে একটি রুশ জাহাজ ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রভাব প্রকাশ্যে এসেছে।
এছাড়া আরও একটি প্রভাব পড়েছে এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ নিয়ে। এগুলোর আগেই জটিলতা তৈরি হয়েছে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধের উপায় নিয়ে।
তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি ও রাশিয়ানরা বলছেন জটিলতা থাকলেও নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে।
গত বছর ডিসেম্বরে রাশিয়ার জাহাজ ‘উরসা মেজর’ রূপপুরের যন্ত্রপতি নিয়ে বঙ্গপোসাগরে আসে। জাহাজটি ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে জাহাজটিকে মোংলায় ভিড়তে নিষেধ করা হয় এবং সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পণ্যগুলো নামাতে না পেরে গত ১৬ জানুয়ারি ফিরে যায়। যদিও এই জাহাজটি গত ডিসেম্বরেই ভারতের কেরালার কচিন বন্দরে সেদেশের পণ্য নামিয়ে মোংলা বন্দরে এসেছিল। ভারতের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা হয়নি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে রূপপুরের যন্ত্রপাতি আনার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়নি।
রূপপুর হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি দেশের ইতিহাসে সব চেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পও। এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি, অর্থসহ সার্বিক প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন (রোসাটম)। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের দুটি ইউনিটেই রিআ্যাক্টর স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে, যেটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান কাজ বলা হয়।
চলতি বছর ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ করে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। যদিও রোসাটম বলছে এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে। যন্ত্রপাতি নামাতে না পেরে ভারতের বন্দর থেকে রুশ জাহাজ ফিরে যাওয়ার পর রোসাটমের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময় সম্পন্ন করার পূর্ণ দায়িত্ব আমাদের। প্রকল্প এলাকায় নির্মাণ কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে আমরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পার্টনারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি, যার মধ্যে, সর্বোত্তম লজিস্টিক্স রুট খুঁজে বের করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
গত ২৬ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইযাফেস ওসমান বলেন, আমাদের সঙ্গে ওদের যে চুক্তি, সেটা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত না মালামাল রূপপুরের নদী বন্দরে পৌঁছাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। আমরা তখনই কনসার্ন হই, যখন আমাদের নদীবন্দরে এসে পৌঁছায়। ওরা (রোসাটম) টাইমলি কাজটা শেষ করবে, আমরা এখনো সেই পথেই আছি। সুতরাং ওইদিকে ভয়ের কোনো কারণ নেই যে অনেক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।
রাশিয়ান জাহাজ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি রূপপুরের প্রকল্প নিয়ে ধীরগতির ভয় আছে কিনা- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ঠিক পথেই আছি। তারা (রাশিয়া) নিশ্চিত করেছে, এটা (রূপপুর) নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে।
এদিকে রূপপুর প্রকল্পের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দেরি হওয়ায় এটির উৎপাদনে যেতেও দেরি হতে পারে। এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দেরি হওয়ার পেছনে মার্কিন নিষেজ্ঞার প্রভাবের কথা জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে জার্মান কোম্পানি সিমেন্স এজি সঞ্চালন লাইনের উপ-কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর ফলে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দেরি হচ্ছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রূপপুরের প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও সঞ্চালন লাইনের জন্য উৎপাদনে যেতে অপেক্ষা করতে হতে পারে। তবে এই সঞ্চালন লাইনের কাজ অনেক আগেই শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি দেরি হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে এই যুদ্ধ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞায় পড়ে বলেও ওই সূত্রটি জানিয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রাশিয়ার ফিরে যাওয়া জাহাজটিতে যে যন্ত্রপাতি ছিল তার ওজন ৫০ টনেরও কম। এগুলো টেকনিক্যাল ধরনের, সংযুক্ত কাজে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি। এ যন্ত্রপতিগুলো কার্গো বিমানেও আনা সম্ভব। এগুলো ফিরে যাওয়ার ফলে নির্মাণ কাজে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রাশিয়া থেকে প্রতিনিয়তই এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আসছে।
এদিকে রাশিয়াকে ঋণ পরিশোধ নিয়ে তৈরি রয়েছে জটিলতা। এই ঋণের টাকা দিতে বাংলাদেশের সমস্যা নেই। কিন্তু গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলারে এই ঋণ পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবলে এই ঋণের কিস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করলেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জটিলতা এড়াতে তাতে রাজি নয়। এই অবস্থায় রাশিয়া ঋণ পরিশোধের তাগিদ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সমাধান খুঁজে বের করতে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল মস্কো পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শিগগিরই প্রতিনিধি দলটি মস্কো যাবে বলেও জানা গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রাশিয়ার সঙ্গে দুটি ঋণ চুক্তি হয়। প্রথমটি ২০১৩ সালে ৫০ কোটি ডলারের, যে অর্থে এই প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। এই ঋণের সুদ ২০১৮ সাল থেকে পরিশোধ শুরু করে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে।
সুত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ের এই ঋণ নিয়মিতই পরিশোধের কাজ চলছিল। ইতোমধ্যেই ৪০ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। বাকি ১০ কোটি ডলার পরিশোধ নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমে জটিলতা তৈরি হয় যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায়। তবে রশিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এসব বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তিমন্ত্রণালয় এবং রূপপুর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, যুদ্ধ শুরু পর যে নিষেজ্ঞাগুলো এসেছে তার ফলে এই প্রকল্পে কিছু প্রভাব পড়তে পারে এটা ধরে নিয়েই রাশিয়া নিশ্চিত করছে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে।
গত বছর অক্টেবরে এ প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের রি-আ্যাক্টর স্থাপনের সময় রোসটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ উপস্থিত ছিলেন। তখন মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকারে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট জটিলতা সত্ত্বেও প্রকল্প নির্মাণ কাজ যাতে শিডিউল অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারে সে জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অবশ্যই আমরা বুঝতে পারছি যে, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং লজিস্টিক্স অবস্থা সামান্য ঝুঁকি হয়তো সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এগুলো মোকাবিলায় আমরা সদা সচেষ্ট আছি।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৩
এসকে/এমএমজেড