ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

কুইক রেন্টাল ঘিরে লুটপাটের মচ্ছব

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১২
কুইক রেন্টাল ঘিরে লুটপাটের মচ্ছব

ঢাকা: নতুন করে নির্মিত ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়েছে পুরনো যন্ত্রাংশ দিয়ে। আর এটাকে কেন্দ্র করেই কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।



সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছে ভাড়া বাবদ কেন্দ্রগুলোর বিপরীতে কেনা দামের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। তবুও নির্দিষ্ট সময়ের পর কেন্দ্রগুলোর মালিকানা পাচ্ছে না পিডিবি।

পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রথম দিকে পুরাতন মেশিন নিয়ে প্রশ্ন তুললে ওপর মহল থেকে বিষয়টিতে নাক না গলানোর জন্য বলা হয়। ”

তিনি বলেন, “একই সঙ্গে বলা হয়, নতুন মেশিন আনছে না কি পুরাতন সে বিষয়ে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন বিদ্যৎ। ” বেশিরভাগ মেশিন তিন থেকে পাঁচ বছর আগের তৈরি করা বলে দাবি করেছেন ওই কর্মকর্তা।

পিডিবির সূত্র জানায়, কোয়ান্টাম পাওয়ারের ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট  ও নোয়াপাড়া ১০৫ পুরনো মেশিন আনা হয়েছে। কোম্পানিটি অটোবির মালিকানাধীন।

সিনহা পাওয়ারের ভোলা ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র ও আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র দুটির জন্য হুন্দাই কোম্পানির পুরাতন মেশিন (প্লান্ট) আনা হয়েছে।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিনহা পাওয়ার কোম্পানির পরিচালক (প্রশাসক) সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি জানান, তারা বিদেশ থেকে নতুন মেশিন নিয়ে এসেছেন।

ডোরেন পাওয়ারের নরসিংদী ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অনেক পুরাতন বলে পিডিবির সূত্র দাবি করেছে। Barakatullah

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরাতন মেশিনের জন্য ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রেও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। পুরাতন মেশিনের কারণে জনতা ব্যাংক একবার ঋণ আটকে দিলে প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরে তদবির করা হয়।

পুরাতন মেশিন আমদানি প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, “দেশে স্থাপিত রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৮০ শতাংশই পুরাতন। সাধারণত এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ কেউ আগে থেকে তৈরি করে রাখে না। ছোট ছোট জেনারেটর তৈরি করে রাখে যার অনেক ক্রেতা রয়েছে। ”

তিনি জানান, এসব মেশিনারিজ কিনতে হলে অর্ডার দেওয়ার পর তারা তৈরি করে, এরপর সরবরাহ করে। প্লেন বা রেলের ইঞ্জিনও তৈরি করে রাখা হয় না। ক্রেতারা চুক্তিবদ্ধ হলে সরবরাহ করে কোম্পানিগুলো।

রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর জন্য তিন থেকে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়। এ সময়ে নতুন করে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে মেশিনারজি আনা সম্ভব নয়। সে কারণে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুরাতন মেশিন দিয়ে চলছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় বলে বিডি রহমতউল্লাহ জানান।

তিনি বলেন, “কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি খাত ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই তৌফিক-ই-ইলাহী গংদের প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। ”

তিনি দাবি করেন, পুরাতন মেশিন নতুন হিসেবে দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।

কুইক রেন্টাল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করে পাওয়ার সেলের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, “একটি কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন করে। তখন ওই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন। চেয়ারম্যান আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কোম্পানিটি যে পুরাতন মেশিন এনেছে, এ অবস্থায় ঋণ দেওয়া ঠিক হবে কি না।  সরকারি মালিকানার ওই ব্যাংক চেয়ারম্যানকে আমি ঋণ না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলাম। ”

বিডি রহমতউল্লাহ দাবি করেন, “পরে সরকারি চাপে সেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিকে ঋণ দিতে বাধ্য হন ওই চেয়ারম্যান। ”

পিডিবি সূত্র  জানায়, তিন বছর মেয়াদি ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য মাসিক ভাড়া ধরা হয়েছে ১৭ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে তার প্রতি মাসের ভাড়া দাঁড়ায় আট লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর তিন বছরের ভাড়া দাঁড়ায় তিন কোটি ছয় লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ২৪৭ কোটি টাকা)। khulna


একইভাবে তিন বছর মেয়াদী কুমারগাঁও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিটের মাসে ভাড়া ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯০ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে মাসে ভাড়া দাঁড়ায় সাত লাখ ৯৫ হাজার ইউএস ডলার। কেন্দ্রটির তিন বছরের মোট মূল্য পরিশোধ করতে হবে প্রায় দুই কোটি ৮৬ লাখ ডলার (প্রায় ২২৯ কোটি টাকা)।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বাংলানিউজকে জানান, ক্যাপাসিটি পেমেন্টের (উৎপাদিত বিদ্যুতের বিপরীতে ভাড়া) নামে যে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে, তা দিয়ে একই ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব।

ফেঞ্চুগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ২৪৭ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এম শামসুল আলম বলেন, “সাধারণত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাতে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ছয় কোটি টাকা। সে হিসেবে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হতো, যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট থেকে মাত্র ৫৩ কোটি টাকা বেশি। ”

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে নতুন-পুরাতন মেশিনের বিতর্ক চলে আসছে। আমরা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে টেকনিক্যাল অডিট করার জন্য লিখিত আবেদন করেছি। এটা হলেই বিতর্কের অবসান হবে। সরকারের সৎ সাহস থাকলে তারা টেকনিক্যাল অডিট করতে সহায়তা করবে। ”

উল্লেখ্য, দেশে এ মুহূর্তে ২৪টি রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক),  ১৮টি কুইক রেন্টাল (দ্রুতভাড়া) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি রেন্টাল ও ১৮টি কুইক রেন্টাল বর্তমান সরকারের সময়ে চুক্তি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১২
ইএস/এআর/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।