► সিন্ডিকেটে শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও আওয়ামী লীগের ৩ এমপি
► সাত মাসের মধ্যে একই মিটারের দামের পার্থক্য ৫,৮৭১ টাকা
► ৪ লাখ ৯০ হাজার মিটারে হাতিয়ে নেওয়া হয় ২৮৭ কোটি
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে বাজারদামের চেয়ে বাড়তি দামে কেনা হয়েছে চার লাখ ৯০ হাজার মিটার।
এ ছাড়া এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও তার এক বন্ধু এবং সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ‘স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার অ্যান্ড মিটার কমিউনিকেশন সিস্টেম স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় লট-১-এ চার লাখ ৯০ হাজার স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার এবং মিটার কমিউনিকেশন সিস্টেম ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহবান করে।
এরপর কাজ পেতে জেবিসিএ অব অকোলিন টেক বিডি লিমিটেড এবং এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস লিমিটেড (JVCA of Oculin Tech BD Ltd. and SQ wire & Cables Ltd.) জয়েন্ট ভেঞ্চারে দরপত্র জমা দেয়। আরেকটি প্রতিষ্ঠান ভিকার ইন্টারন্যাশনাল জেভি এক্সজে মিটারিং কম্পানি লিমিটেড এবং জেভি গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড (Vicar International JV XJ Metering Co. Ltd. JV Global Brand Pvt. Ltd.) জয়েন্ট ভেঞ্চারে দরপত্রে অংশ নেয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জেবিসিএ অকোলিন টেক বিডি লিমিটেডের মালিক হচ্ছেন শাদাব সাজিদ, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে ববির বন্ধু। একই জয়েন্ট ভেঞ্চারের অন্য প্রতিষ্ঠান এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ এম ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী। আর প্রতিষ্ঠানটির মালিক হিসেবে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের নাম। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত।
অন্যদিকে দরপত্রে অংশগ্রহণ করা অন্য প্রতিষ্ঠান ভিকার ইন্টারন্যাশনালের মালিক নাজমুল হোসেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এবং ২০০৮ থেকে ২০১৪ মেয়াদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হকের ভাই।
দরপত্রে দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও কাজ পায় ববি, বিপু, শাদাব, ফখরুল সিন্ডিকেট। তাদের দুটি প্রতিষ্ঠান জেবিসিএ অব অকোলিন টেক বিডি লিমিটেড এবং এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস লিমিটেড প্রতিটি মিটার ১২ হাজার ২৫৩ টাকা দামে সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে দরপত্র জমা দেয়। এই দামে তারা চার লাখ ৯০ হাজার মিটার সরবরাহ বাবদ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা এবং মিটার কমিউনিকেশন সিস্টেম সরবরাহ বাবদ ৬৩৫ কোটি টাকাসহ মোট এক হাজার ২৩৫ কোটি টাকার কাজ পায়, যা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত দামের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
চার লাখ ৯০ হাজার স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারের দরপত্রে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে সেটি প্রকাশ্যে আসত না, যদি আট মাস পর একই মিটার ক্রয়ের টেন্ডার না হতো।
২০২২ সালের ৩ নভেম্বর লট-১-এর আরেকটি প্যাকেজে একই মিটারের দরপত্র আহবান করা হয়। এই দরপত্রেও অংশ নেয় ববি, বিপু, শাদাব, ফখরুল সিন্ডিকেটের এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেবলস লিমিটেড। কিন্তু এবার তারা প্রতিটি মিটার ছয় হাজার ৩৮২ টাকায় দেবে বলে উল্লেখ করে দরপত্র জমা দেয়। তবে এই দরপত্রেও মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত দামের চেয়ে প্রায় ১৩.৮০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দরপত্র জমা দেওয়া হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২ সালের এপ্রিলে যে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার ১২ হাজার ২৫৩ টাকায় কেনা হয়েছিল, একই বছরের নভেম্বরে সেটি কেনা হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৩৮২ টাকায়। প্রতি মিটারে দামের পার্থক্য প্রায় পাঁচ হাজার ৮৭১ টাকা। অর্থাৎ চার লাখ ৯০ হাজার মিটার সরবরাহের একটি লটে অন্তত ২৮৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান একই। জালিয়াতি অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠানও এক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সঠিক হারে দাম নির্ধারণ করে ক্রয় প্রস্তাব দিলে জালিয়াতির পরিমাণ আরো বাড়বে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, চার লাখ ৯০ হাজার মিটারের সঙ্গে এক হাজার ৬০০টি ডিসিইউ, ছয় হাজার ৪০০টি রিপিটারের মূল্য বিবেচনায় নিলে প্রতিটি মিটারের জন্য সরকারের ব্যয় দাঁড়াবে ২৫ হাজার ২০৬ টাকা। সব মিলিয়ে স্মার্ট মিটার স্থাপনের একটি লটে অন্তত ৪০০ কোটি টাকার জালিয়াতি করা হয়েছে।
স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারের আন্তর্জাতিক বাজারদর হিসাব করে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের টেন্ডার জালিয়াতি করে পুকুরচুরি করা হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দরপত্রে চাওয়া সিঙ্গল ফেজ ইলেকট্রিক মিটারের দাম ছয় ডলার থেকে শুরু করে ভালো মানের মিটারের দাম ৩৫ ডলার। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে এই মিটারের দাম সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে শুরু করে চার হাজার ২০০ টাকা (এক ডলার সমান ১২০ টাকা)। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড যদি ভালো মানের মিটারের দরপত্রও আহবান করে তাহলে প্রথম লটে প্রতিটি মিটারে প্রায় আট হাজার ৫০০ টাকা বেশি দাম ধরে কাজ দিয়েছে। আর দ্বিতীয় লটের কাজেও প্রায় দুই হাজার ২০০ টাকা বেশি দাম কাজ দেওয়া হয়েছে।
স্মার্ট মিটার স্থাপন প্রকল্পে জালিয়াতি করায় সরকারের পাশাপাশি গ্রাহকদের ওপরও বাড়তি অর্থের চাপ পড়েছে। কারণ প্রতিটি মিটার ক্রয়ের অর্থ বাবদ গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মিটার ক্রয়ে জালিয়াতির কারণে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়েছে গ্রাহকদের। যদি সঠিক দামে এসব মিটার কেনা হতো তাহলে প্রতি মাসে মিটার চার্জ বাবদ গ্রাহকদের অনেক কম অর্থ পরিশোধ করতে হতো।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই দরপত্রে প্রতারণা, যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। তারা পারস্পরিক যোগসাজশে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করেছেন। সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার কথা বলে এখানে অতিমূল্যায়িত দাম ধরে প্রি-পেইড মিটার কিনে সরবরাহ করা হয়েছে। এর দায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং যাঁদের নাম এখানে আসছে, তারা এড়াতে পারেন না। ’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারব না। ’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক সংসদ সদস্য এ এম ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুলকে মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাদের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪