ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিশ টাকার বিদ্যু‍ৎ সংযোগে বিশ হাজার

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৫
বিশ টাকার বিদ্যু‍ৎ সংযোগে বিশ হাজার ছবি: সংগৃহীত

হাজীগঞ্জ (চাঁদপুর) থেকে ফিরে: বিশ টাকায় বিদ্যু‍ৎ সংযোগ পাওয়ার কথা থাকলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে বিশ হাজার করে টাকা আদায় করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
 
একেক এলাকা একেকজন নেতা ভাগ করে নিয়েছেন।

নেতার পদবি অনুযায়ী বিদ্যুতের সংযোগ ফি’তেও রয়েছে তারতম্য। সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকা নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন। তার এরিয়াতে বিদ্যুতের দাম বেশি।
 
আওয়ামী লীগের এই নেতা পাঁচই গ্রামের ৮৮ জনের কাছ থেকে ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। সম্প্রতি সেখানে বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। খুব শিগগিরই সংযোগ দেওয়া হবে। এজন্য গ্রাহকদের ঘর ওয়্যারিং করার নির্দেশ দিয়েছেন সরকার দলীয় এই নেতা।

পাঁচই (দক্ষিণপাড়া) গ্রামের রোস্তম খানের ছেলে মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, তিনি ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন সংযোগের জন্য। জসিম উদ্দিন মোট ৩ দফায় এই টাকা দিয়েছেন তার আত্মীয় নুর মোহাম্মদের মাধ্যমে। তার (মোশাররফ) প্রতিবেশী গিয়াস উদ্দিন ও জাফর খাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর হোসেনও ২০ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছেন।
 
বিদ্যুৎ সংযোগের অপেক্ষায় থাকা একই গ্রামের মাহবুবুর রহমানের মা বাংলানিউজকে জানান, ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছি। আরও দিতে হবে কি না বুঝতে পারছি না।

চাঁদপুর পল্লীবিদ্যু‍ৎ সমিতি সূত্র জানিয়েছে, পাঁচই গ্রামে নতুন লাইন বসানো হচ্ছে। এখানে সব কিছু ফ্রি দেবে সরকার। গ্রাহক শুধু ২০ টাকায় একটি ফরম নিয়ে আবেদন করবেন।
 
পাঁচই গ্রামের উত্তরাংশে আগে থেকেই বিদ্যুৎ রয়েছে। নতুন করে দক্ষিণাংশে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এজন্য আবেদনকারী ৮৮ জনের কাছ থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এর বেশিরভাগ টাকাই নুর মোহাম্মদের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে। তবে টাকাটা কেউ কেউ সরাসরি জসিমের হাতে দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
 
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জসিম উদ্দিন বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায় নি। বাড়ির লোকজন জানিয়েছেন, তিনি স্থানীয় এমপির সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় গেছেন। জসিম উদ্দিনের মোবাইলে ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তা কেউ রিসিভ করেননি। ‍
 
উপজেলার সাদবাড়িভাঙ্গা গ্রামেও নতুন লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। তার টানানো শেষ হয়েছে, তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় নি। ওই গ্রামের বাসিন্দা সালামত উল্লাহ (পিতা আব্দুল মজিদ) বাংলানিউজকে জানান, তিনি দু’টি সংযোগের জন্য আবেদন করেছেন।
 
এজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমানকে ৯ হাজার টাকা দিয়েছেন। আরো টাকা দিতে বলেছেন। না হলে সংযোগ দেওয়া হবে না বলে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাকা দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় চেয়েছেন। জবাবে তাকে বলা হয়েছে, টাকা দিলে সংযোগ পাবেন। না হলে আপনার সংযোগ বাদ পড়বে।
 
একই গ্রামের মাওলানা হুমায়ুন কবীর পিতা আব্দুল কাদের মুন্সী বাংলানিউজকে জানান, এমপির লোক হিসেবে পরিচিত স্থানীয় নেতা মুখলেছুরকে ৬ হাজার টাকা দিয়েছেন। এই গ্রামে প্রায় দুই বছর আগে খাম্বা বসানো হয়েছে। আর সম্প্রতি লাইন টানানো হয়েছে। এখানে ৬৫টি সংযোগের জন্য তালিকা করা হয়েছে।
 
সাদবাড়িভাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কীর্তনখোলা গ্রামে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। ওই গ্রামে ১৭০টি সংযোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ওই গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে অর্থ আদায়ে যুক্ত রয়েছেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবুল মিয়াও।
 
ওই গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা (স্বামী ইউসুফ) বাংলানিউজকে জানান, তার স্বামীরা ৩ ভাই বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য মোট ১৮ হাজার টাকা দিয়েছেন।

রোজিনা বেগম আরো জানান, এক বছর আগেও তারা অন্য একজনকে ৫ হাজার টাকা দেন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য। কিন্তু সংযোগ পান নি। এমনকি টাকাও ফেরত পান নি।
 
একই উপজেলার লোধপাড়া গ্রামেও নতুন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এই গ্রামে ১১০টি সংযোগের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। স্থানীয়রা সকলেই এক বাক্যে এই টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা মোবারক (পিতা ফজলুল হক) বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, সংযোগের জন্য ৭ হাজার ৭’শ টাকা দিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ হোসেনকে।
 
৮ মাস আগে প্রথম ১ হাজার, এরপর ৫২’শ এবং সম্প্রতি আরও দেড় হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংযোগ পাননি। চলতি সপ্তাহে তাকে আরও ২২’শ টাকা অর্থাৎ দশ হাজার টাকা পূরণ করতে বলা হয়েছে। না হলে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 
ইউসুফ হোসেনের সহযোগী সামছুল আলম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে আদায় করার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, আমরা যাতায়াত করছি এর একটা খরচ আছে না। তাছাড়া আমরা তো জোর করে টাকা নিই নি। মানুষ টাকা খরচ করে হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে চায়। আমরা সেই চেষ্টা করছি।
 
চাঁদপুর পল্লীবিদ্যুত সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. ইউসুফ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, যেখানে সরকারিভাবে লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে সেসব এলাকায় সব ফ্রি। ওই সব এলাকার গ্রাহকরা শুধু ২০ টাকা দিয়ে ফরম নিয়ে জমা দেবেন। এছাড়া কেউ যদি নিজের থেকে খাম্বা কিনে সংযোগ নিতে চায় তাদের পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
 
সংযোগের জন্য অর্থ আদায় প্রসঙ্গে মো. ইউসুফ বলেন, আমাদের কোনো লোক এর সঙ্গে জড়িত নেই। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
তিনি বলেন, আমরা ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালিয়েছি যাতে কেউ দালালের হাতে টাকা না দেন। প্রত্যেকটি এলাকায় ৭ দিন করে মাইকিং করেছি। লিফলেট হ্যান্ডবিল ছাড়া হয়েছে। আমরা বলেছি সবাই সংযোগ পাবেন। এরজন্য কাউকে টাকা দিতে হবে না। কিন্তু তারপর্ও কেউ যদি কাউকে অর্থ দেয় আমাদের করার কি আছে!
 
২০১৪ সালে প্রায় ২৭ হাজার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আরও অপক্ষমান রয়েছে ১৪ হাজার। চাঁদপুর সমিতির আওতায় ১ হাজার ৩১৬টি গ্রাম রয়েছে। যার মধ্যে ৯৪২ টি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। ৩৭৪ গ্রামে এখনও বিদ্যুত পৌছেনি। তবে ২০১৭ সালের মধ্যে সকলের ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে যাবে বলে জানিয়েছে জেনারেল ম্যানেজার।
 
১৫টি গ্রাম ঘুরে এমন কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায় নি যিনি টাকা না দিয়ে সংযোগ পেয়েছেন। এমনও লোক পাওয়া গেছে যারা দু’দফায় টাকা দিয়ে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পান নি। আর প্রকাশ্যেই এই সংযোগ-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। এরা স্থানীয় এমপি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের কাছের লোক বলে পরিচিত। এ-কারণে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
 
আর এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাইনুদ্দীন, সংসদ সদস্যের খালাতো ভাই শাহীন। তৃণমুল পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যেভাবে ঘরে ঘরে টাকা আদায় করা হচ্ছে এতে কতিপয় নেতা লাভবান হলেও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা একাধিকবার এমপিকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেন নি। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
 
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আসেনি। অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। কেউ অর্থ আদায় করলে তিনি যে দলেরই হোক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।