ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

কর্তাদের পকেটে ৪৮ কোটি

রাষ্ট্রের লোকসান ১২শ’ কোটি টাকা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
রাষ্ট্রের লোকসান ১২শ’ কোটি টাকা

ঢাকা: চীনা প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব দিয়েছিলো ২ হাজার ৩৭০ কোটি ৮৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকার। আর স্প্যানিশ কোম্পানি দর প্রস্তাব করেছিলো ২ হাজার ২২৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৯ টাকা।

সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে স্প্যানিশ কোম্পানিকে কাজটি দেওয়া হয়।

কিন্তু শর্তের বেড়াজাল আর কর্তাদের অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে সেই দর গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৩২শ’ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১২শ’ কোটি টাকা বাড়তি পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ইপিসি ঠিকাদারকে অর্থ বাড়িয়ে দেওয়ার এমন ঘটনা নজিরবিহীন। কিন্তু সেই কাজটিই করা হয়েছে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে।

আর এর বিনিময়ে কর্মকর্তাদের পকেটে গেছে ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৪৮ কোটি টাকা। এই ঘুষের টাকার একটি অংশের লেনদেন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিসকোর একটি ব্যাংকে। ওই ব্যাংকে রয়েছে এপিএসসিএলের সাবেক এমডি প্রকৌশলী নুরুল আলমের ছেলে মাহফুজ আলমের অ্যাকাউন্ট। সেই অ্যাকাউন্টেই স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে পাঠানো হয়েছে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৬ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর দরপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় ছিলো। দুই স্তরের এ দরপত্রে প্রথমে ৯টি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। আর দ্বিতীয় স্তরে বা চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনটি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। এগুলো হচ্ছে চীনা ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএনটিআইসি), আইসোলেক্স ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড স্যামসং করপোরেশন ও টেকনিকাস রিইউনিডাস (টিআর) ও টিএসকে ইলেকট্রনিক। এর মধ্যে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আইসোলেক্সকে দরপত্রে অযোগ্য ঘোষণা করে।

আইসোলেক্সকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে এ দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রথমেই অযোগ্য ঘোষণা করার কথা ছিলো স্পেনের দুই কোম্পানি টিআর ও টিএসকে। কারণ কোম্পানি দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে দরপ্রস্তাব দিয়েছে তা ছিলো পিপিআর অনুযায়ী অসঙ্গতিপূর্ণ।

চীনা কোম্পানি দরপ্রস্তাবে কোন আপোষরফা করা যাবে না উল্লেখ্য করলেও আপোষরফা করা যাবে বলে উল্লেখ করে স্প্যানিশরা। বাংলাদেশের পিপিআর অনুযায়ী, চূড়ান্ত দরপ্রস্তাবে আপোষরফার কোন সুযোগ নেই। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তাদের কাগজপত্রে লিখেছে, স্পেনের দুই কোম্পানির চেয়ে চীনের কোম্পানির দরপ্রস্তাব বেশি হওয়ায় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়া হল।

এপিএসসিএল সূত্র জানিয়েছে, অংকের হিসেবে স্পেনের কোম্পানি একশ’ ৪৪ কোটি টাকা কম দরপ্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু একটি বিশেষ শর্তজুড়ে দিয়েছে স্পেনের দুই কোম্পানি যা দরপত্র পিপিআর অনুযায়ী দেয়া সম্ভব নয়। ওই বিশেষ শর্ত হল, দরপ্রস্তাব নিয়ে আপোষরফা করা যাবে। আর সেই আপোষরফার শর্তে দেড় শ’ কোটি টাকা কমে কাজটি নিলেও কাজটি যখন শেষ হতে চলেছে তখন এর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ১২শ’ কোটি টাকা।

অভিজ্ঞতার সনদ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কোম্পানি দু’টির বিরুদ্ধে। দরপত্রে অংশ নিতে হলে একই ক্ষমতার (৪৫০ মেগাওয়াটের কমবাইন্ড সাইকেল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ১০ বছরের ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টশান) কনট্রাক্টর অথবা টার্নকি প্রক্রিয়ায় (নির্মাণ শেষে কর্তৃপক্ষকে শুধু চাবি বুঝিয়ে দেওয়া)অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক। স্প্যানিশ কোম্পানি টিআর ও টিএসকে’র এরকম কোন অভিজ্ঞতা নেই। দরপত্রে জমা দেয়া অভিজ্ঞতাগুলো সবই জালিয়াতি বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্পেনের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৮০ মেগাওয়াটের। ৩৬০ মেগাওয়াটের সৌদি আরবে একটি কেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকলেও সেখানে তারা ইপিসি কনট্রাক্টরের কাজ করেনি।

এপিএসসিএল’র বোর্ড চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন বলেন, যা কিছু করা হয়েছে নিয়ম অনুযায়ী করা হয়েছে। কোন রকম অনিয়ম করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ সঠিক নয়।

এ বিষয়ে জানতে অনেকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি অভিযুক্ত এপিএসসিএল’র সদ্য বিদায়ী এমডি নুরুল ইসলাম। এমনকি এসএমএস দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বেআইনি সুবিধা দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত করছে। এ কারণে এখনি কোন মন্তব্য করতে চাই না।

উল্লেখ্য, ঠিকাদার নিয়োগে জালিয়াতির মাধ্যমে ঘুষ লেনদের সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট বাংলানিউজে প্রকাশিত হয়। সেই খবরের ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আরস্তু খানকে প্রধান করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে আমেরিকান ব্যাংকের কাছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
এসআই/জেডএম

** তদন্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত
** বিনিময় ছয় মিলিয়ন, দেশের ক্ষতি ৪৫ মিলিয়ন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।