ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

ঋণ নিয়ে বিপাকে বাপেক্স

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
ঋণ নিয়ে বিপাকে বাপেক্স

ঢাকা: পরে যে কাজটি করা উচিত ছিলো, সেই কাজটিই বাপেক্সকে আগে করতে হয়েছে। গ্যাসকূপ খননে অতি উচ্চ দরে গাজপ্রমের সঙ্গে চুক্তি করার পর এ কাজে প্রতিষ্ঠনটির টাকার যোগান এসেছে ঋণ হিসেবে।

সেসব কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে না বললেই চলে, অথচ সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানিটিকে।
 
কার হাতে বাপেক্সের নিয়তি, কোনটি আগে প্রয়োজন, আর কোন কাজটি পরে করা লাভজনক, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানিটি। সবটাই নির্ধারিত হচ্ছে ‍অদৃশ্য শক্তির খেয়ালখুশিতে। বাপেক্সের স্বার্থের বদলে অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
 
বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, ২০১২ সালে যখন বাপেক্সের ৫টি কূপ খনন করার জন্য অতি উচ্চ দরে গাজপ্রমের সঙ্গে চুক্তি করা হয়, তখন কথা উঠেছিলো এর যৌক্তিকতা নিয়ে। বলা হয়েছিলো, এসব কূপে গ্যাস পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া যাবে না।
 
বাপেক্সের মিড লেভেলের কিছু কর্মকর্তা তখন এর মৃদু বিরোধিতা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এসব ফিল্ডে গ্যাস পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনই উত্তোলন করা যাবে না। এর চেয়ে বাপেক্স নিজে যদি ওই পাঁচটি কূপ খনন করে তাহলে কমপক্ষে ৮শ’ কোটি টাকা কম খরচ হবে।
 
তখন অযথা বাপেক্সের কাঁধে ঋণের বোঝা না চাপানোর অনুরোধ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এ সম্পর্কিত একটি নিউজ বাংলানিউজে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শেষ পর্যন্ত বাপেক্সের সেমুতাং ফিল্ডে একটি, বেগমগঞ্জে একটি, শ্রীকাইলে একটি ও শাহবাজপুর ফিল্ডে দু’টি কূপ খননের জন্য গাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হয়। আর এর অর্থায়নের জন্য বাপেক্সকে ঋণ হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা দেয় পেট্রোবাংলা। যা ২ শতাংশ হারে সুদসহ গুণতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
 
কিন্তু শুধু শ্রীকাইলের কূপটি থেকে প্রথম থেকেই গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। শাহবাজপুর ফিল্ড দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর গত মাস থেকে সামান্য পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। শাহবাজপুরে দুই নম্বর কূপটি ২০০৮ সালে গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু প্রসেস প্লান্টের অভাবে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ ছিল। এসব কারণে বাপেক্স এ কূপটি খনন করার পক্ষে ছিল না। তারা চেয়েছিল নিজেরাই খনন করবে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করতে হয় দেশিয় এ কোম্পানিটিকে।
 
একইভাবে বেগমগঞ্জ থেকেও সহসা গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। বেগমগঞ্জে কূপ খনন করার পর দীর্ঘ সময় বসে ছিল। সম্প্রতি সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বাপেক্স। তাও পুরোমাত্রায় উত্তোলনে যেতে পারছে না। এখন প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কার স্বার্থে তড়িঘড়ি করে কূপ খনন করা হলো। যখন গ্যাস উত্তোলন করতে এতোদিন সময় নেওয়া হলো তাহলে বাপেক্স নিজেই কূপ খনন করতে পারত। এতে একদিকে যেমন ব্যয় কমত, অন্য দিকে ঋণের সুদ গুণতে হতো না বাপেক্সকে।
 
বাপেক্স’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, এই কাজগুলোতে তিন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাপেক্স। প্রথমত বেশি দর, দ্বিতীয়ত আগে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, যা থেকে রিটার্ন আসছে না। তৃতীয়ত সুদ পরিশোধ।  
 
২০১২ সালে যখন রাশিয়ান কোম্পানি গাজপ্রমেকে এসব কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়। তখন রাশিয়ানদের চেয়ে বেশি দৌড়ঝাপ করতেন তাদের দেশিয় এজেন্ট আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম রহমত উল্লাহ। সঙ্গে জাতীয় পার্টির এক নেতাও ছিলেন। যে কারণে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন বিষয়টি।  
 
বাপেক্সকে ঋণ প্রদানের সময়ও প্রতারণা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সেই অর্থে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। কথা ছিল, এ তহবিল থেকে দেশিয় কোম্পানিকে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। যাতে দেশিয় গ্যাস কোম্পানিগুলো সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে পেট্রোবাংলা ব্যবসা শুরু করেছে।    
 
বাপেক্স’র মহাব্যবস্থাপক (খনন বিভাগ) বাংলানিউজকে জানান, এ ঋণের বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন আসছে দেরিতে। কিন্তু সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে এখনই। এতে বাপেক্স সঙ্কটে পড়তে পারে।
 
বাপেক্সের স্বার্থে এ ঋণের সুদ মওকুফ হওয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 
বাপেক্সের অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুদসহ এ ঋণের কিস্তি বাপেক্সকে পরিশোধ করতে হলে অর্থ সংকটে পড়বে প্রতিষ্ঠানটি। হাজার কোটি টাকার ২ শতাংশ সুদ দিতে হলে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।
 
আগের ঋণ নিয়ে যখন সংকটে রয়েছে বাপেক্স। ঠিক সেই সময়ে আবার ‌উচ্চ দরে কাজ দেওয়া হচ্ছে গাজপ্রমকে। আর বাপেক্স কমদরে ভাড়া খাটতে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানাধীন বাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ডে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
এসআই/আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।