গত ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০১০, নারী ম্যাগাজিনের সামান্য কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় আমি আর আমার বন্ধু কাউন্সিলর আয়েশা চৌধুরী ইস্ট লন্ডনের সিএম মিডিয়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে যাবার পর দেখা হলো সাংবাদিক, কলামিস্ট ইসহাক কাজল এবং গবেষক ফারুক আহমেদের সাথে।
উত্তরে বলেছিলাম, ইসহাক ভাই আমরা প্রগতিশীল এবং বরাবরই নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কোনো বৈষম্য মাথায় রেখে ম্যাগাজিনের নাম ’নারী’ দেইনি, এখানে ছেলেদের লেখাও ছাপা হবে। এরপরও উনার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, কাগজটির নাম ’নারী’ দেওয়ায় উনি তেমন খুশি নন। তিনি বলেছিলেন, সারা জীবন নারী পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি। নারী ও পুরুষের মধ্যে আমি কখনও পার্থক্য দেখি না, কাগজ থাকবে সবার জন্য উন্মুক্ত। যেখানে নারী পুরুষ একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে লিখবে। আমরা কোনো ক্ষেত্রেই নারীদের ছোট করে দেখতে পারি না। এ সমাজে নারীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তা আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। এ ছাড়াও তিনি আরো বলেছিলেন, আজকের এই ইসহাক কাজলের পেছনে যে মানুষটির অবদান ছায়ার মতো কাজ করেছে , তিনি হচ্ছেন ইসহাক ভাইয়ের স্ত্রী ফাতেমা বেগম। যার প্রেরণা এবং সহযোগীতায় তিনি আজ এতদূর এগিয়ে এসেছেন।
সেদিন ইসহাক ভাইয়ের সাথে এ ব্যাপারে আমাদের কথাবার্তা আর অগ্রসর হয়নি। ওই সময়টাতে আমরা সবাই খুবই ব্যস্ত ছিলাম, তা ছাড়া উনারাও বেশ তাড়ার মধ্যে ছিলেন। মাত্র কয়েকটা দিন বাকি ঈদুল ফিতরের, আমাদের টার্গেট যে করেই হোক ঈদের আগে ম্যাগাজিনটি পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়া। তাই গভীর মনোযোগে আমরা কাজগুলো শেষ করতে লাগলাম। রাত্রে বাসায় ফিরে ইসহাক ভাইয়ের কথা বারবার মনে পড়ছিল।
আমাদের সমাজে ক’জন পুরুষ আছেন যারা জনসম্মুখে নিজ স্ত্রীর যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রশংসা করেন। ঘরে সুন্দরী, স্মার্ট ও গুণবতি স্ত্রী রেখে পরিচিত অনেককেই দেখা যায় অন্য নারীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন। অথচ নিজ স্ত্রীর প্রশংসা এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতে এরা একেবারেই বিমুখ। এছাড়াও পরিচিত অনেক পুরুষ আছেন, বড় বড় সমাবেশে ও বক্তৃতায় যারা অহরহ নারী উন্নয়ন, অগ্রগতি, নারী নির্যাতন ও বৈষম্য বন্ধের দাবীতে জ্বালাময়ী কথা বলেন, সেই সব বক্তাদেরও দেখেছি বাড়ীতে গিয়ে নিজ স্ত্রীকে মানসিক ও শারিরীকভাবে অত্যাচার করতে, ঘরের কাজের মেয়েকে নোংরা ভাষায় গালি দিতে।
আমাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো গড়ে তোলা সভ্য সমাজে চলার পথে অনেকের সাথে পরিচিত হতে হয়, যারা মুখে এক আর ভেতরে অন্য ধ্যান ও ধারণা পুষে বেড়ান। দ্বৈত চরিত্র ও বহুরূপ ধারণ করে যারা বড় বড় কথা জনসম্মুখে বলে বেড়ান তারা যদি নারী পুরুষের বৈষম্য মাথায় না রেখে ইসহাক কাজলের মতো নিজ স্ত্রীকে মূল্যায়ন করতেন এবং সমাজের প্রতিটি নারীকে দুর্বল ও ভোগের বস্তু মনে না করে যথাযথ সম্মান করতেন, তা হলে হয়তো পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতন কিছুটা হলেও লাঘব হতো।
এবার ফিরে আসি মূল কথায়, বিগত দিনে বিলেত থেকে অসংখ্য কাগজ বেরিয়েছে, এবং বিভিন্ন কারণে প্রকাশিত অনেকগুলো কাগজের পথচলা বেশ দীর্ঘ হয়নি। নব্বই দশকের গোড়ায় বিলেত আসার পর একটি কাগজের স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে বুকে লালন করে আসছিলাম। বিশেষ করে, বিলেতের বাঙালি নারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন কাগজ না থাকায় ’নারী’ ম্যাগাজিনের স্বপ্ন বেশ আগেই মনের মধ্যে পেখম মেলেছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিশিষ্ট কলামিষ্ট, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন (যে মানুষটিকে আমি বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করি এবং লেখালেখির জগতে সরব হওয়ার জন্য যার উৎসাহ ও প্রেরণা সবসময়ই ছায়ার মতো কাজ করেছে) ভাইয়ের সাথে আলাপ করতাম। নজরুল ইসলাম বাসন বরাবরই উৎসাহ দিতেন। তবে এখানে বলা বাহুল্য যে, নজরুল ইসলাম বাসন শুধু আমাকেই নয় লেখালেখির ব্যাপারে বিলেত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে অনেককেই উৎসাহ দিয়ে লেখক বানিয়েছেন, যারা ইদানিং ভালোই লিখছেন। এবং বর্তমানেও এই মানুষটি নীরবে নিঃশব্দে অনেক নতুনদের লেখালেখির ব্যাপারে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন।
অনেক ভেবে চিন্তে ২০০৬ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাসন ভাইয়ের সহযোগীতায় শেষ পর্যন্ত ‘উৎসব’ নাম দিয়ে কাগজটি প্রকাশনা শুরু করেছিলাম। এরপর ব্যক্তিগত কাজ ও সময়ের অভাবে কিছুদিন বিরত থেকে গত বছরের শুরুর দিকে আবার কাগজটি প্রকাশনায় হাত দিলাম। তবে এবার কাগজটির নাম পরিবর্তন করে ‘নারী’ নামেই প্রকাশিত হচ্ছে, এবং আগামীতেও ‘নারী ’নামে কাগজটির প্রকাশনা অব্যহত থাকবে।
অনেকেই হয়তো জানেন, প্রবাসে নিজ উদ্যোগে একটি কাগজ বের করা সত্যিই কষ্টকর, এরপরও নারী পরিবার স্বপ্নহীন ও আশাহত না হয়ে পাহাড়সম বাসনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নারী ম্যাগাজিন প্রকাশের পর আমরা পাঠকদের কাছ থেকে সত্যিই অভুতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। বিশেষ করে, বিলেতের নারীদের কাছ থেকে যেটুকু প্রেরণা পাচ্ছি তা আগামী পথ চলার সোনালী রশ্মি হিসাবেই কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আজকের লেখার মূল কারণ, ইসহাক ভাই ছাড়াও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পাঠক আমাদের জিজ্ঞাস করেছেন কাগজটির নাম ’নারী’ কেন? তাদের উদ্দেশে বলছি, নারী মানেই সমাজ, সংসার সবকিছু। পরিবারের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান অতুলনীয়। একজন নারী তার জীবনে তিনটি রূপে প্রকাশিত হন। জীবনের প্রথম কন্যা হয়ে বাবা-মার কোল ভরে দেন চাঁদের মতো মিষ্টি হাসি দিয়ে, যৌবনে একজন জয়া হয়ে প্রেমিকের হাতে তুলে দেন মুঠো মুঠো কাশফুল, রাশি রাশি সোনালি স্বপ্ন। আবার মধ্যবয়সে এসে এই নারীই জননী রূপে সন্তানের জন্য হয়ে যান মমতার ভান্ডার। একটি রাষ্ট্র যেভাবে সমাজ, কৃষ্টিসহ সমষ্টিগতভাবে গঠিত, ঠিক তেমনি একজন নারীকে নিয়ে গঠিত হয় একটি পরিবার। তাই অনেক ভেবে চিন্তে কাগজটির নাম দেয়া হয়েছে ’নারী’।
তবে এ কথা ঠিক এই কাগজটি মূলত একটা নারী বিষয়ক কাগজ । কিন্তু এখানে লেখকদের ব্যাপারে কোনো বৈষম্য নেই। যে কোনো লেখক নারী কাগজে লিখতে পারবেন। আমাদের ভিন্নতা হলো এইটুকু যে, কাগজটিতে নারী বিষয়ক লেখা হয়তো একটু বেশিই হবে। কারণ বিলেতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দু’সপ্তাহ অথবা মাসে একবার মহিলা পাতা ছাপা হয় এবং ওই সব নারী পাতায় নারীদের জন্য পর্যাপ্ত নারী বিষয়ক লেখা থাকে না। যা থেকে নারী পাঠকরা তাদের চাহিদা মতো আহার পান না।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন বেশ দাপটের সাথে। বাংলাদেশেও আমাদের নারীরা পিছিয়ে নেই, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক থেকে শুরু করে ট্রেনের চালক, হাইকোর্টের বিচারপতি, গবেষকসহ আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। বিলেতের মাটিতেও বাঙালি নারীরা বড় বড় উচ্চপদস্থ পেশায় নিয়োজিত হয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছেন বিশ্বের দরবারে। ইন্টরনেটের এই যুগে বিশ্বে নারী উন্নয়ন ও অগ্রগতিসহ বিভিন্ন খবরাখবর আমাদের পরিচিত অনেক নারীদের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে।
নারী ম্যাগাজিন প্রকাশের একমাত্র কারণ বিশ্বব্যাপী নারী বিষয়ক প্রশংসাসূচক এবং পজিটিভ খবরাখবর, বিনোদন, রান্না, সাহিত্য, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ, অনুবাদসহ প্রতিটি অঙ্গনকেই বিলেতের নারীদের কাছে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা। তবে এ কথা চরম সত্য যে, কাগজটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
নারী ম্যাগাজিন সর্বপ্রকার অন্যায় ও বৈষম্যের উর্ধ্বে সর্বদা কাজ করার অঙ্গিকার পোষণ করছে।
লেখক: সম্পাদক, নারী ম্যাগাজিন