লিজবন, পর্তুগাল থেকে: ইউরোপ থেকে ভারত যাওয়ার জলপথ আবিষ্কারের নায়ক ভাস্কো দা গামা’র পর্তুগালে বাংলাদেশিদের বসতি স্থাপনের ইতিহাস খুব বেশি দিন আগের নয়। তবে যে অল্প সময়ে বসতি গড়ে উঠেছে, তার মধ্যেই শান্তিপ্রিয় অভিবাসী জনপদ হিসেবে এখানে দারুণ ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন বাংলাদেশিরা।
পর্তুগিজ মূলধারার সঙ্গে ঘনিষ্ট বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা, ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির কাউন্সিলর রানা তসলিম উদ্দিন নিজের কমিউনিটির এই সুনামের কথা খুব গর্ব করেই বললেন বাংলানিউজকে। লিজবনের বাঙালি পাড়া মারটিম মনিজের কফি হাউসে শাহীন সাঈদ ও লিজবন ইন্টারন্যাশনাল বাংলা অ্যাসোসিয়েশনের মহিউদ্দিন সুমনকে সঙ্গে নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলছিলেন রানা।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে প্রথম এথনিক কমিউনিটি হিসেবে পর্তুগালে বাংলাদেশিদের যাত্রা শুরু হলেও আশির দশকের শুরুর দিকে কয়েকজন বাংলাদেশি প্রথম এসেছিলেন পর্তুগালে। কিন্তু তাদের সবাই টিকেননি একসময়ের সাম্রাজ্য বিস্তারে বিশ্বাসী এই দেশটিতে। এদের মধ্যে মাত্র দু’জন বাংলাদেশি পর্তুগিজ নারী বিয়ে করে এখানে শুরু করেন বসতি স্থাপন।
রানা জানান, তিনি নিজে প্রথম লিজবন আসেন ১৯৯১ সালে। তাকে নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির সদস্য সংখ্যা তখন দাঁড়ায় ৬ জনে। ১৯৯২ সালে এই সংখ্যা যখন বেড়ে দাঁড়ায় ১২ জনে, তখনই রানা তসলিম উদ্দিনের উদ্যোগে সাংগঠনিকভাবে পর্তুগালে শুরু হয় বাংলাদেশিদের যাত্রা। ১৯৯৩ সালে পর্তুগাল সরকার অভিবাসীদের বিশেষ বৈধকরণের ঘোষণা দিলে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৫০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি লিজবনে এসে এখানকার বৈধ বাসিন্দা হিসেবে বসবাস শুরু করেন।
বসতি স্থাপনকারীদের অধিকাংশই তখন বেকার, সেজন্য শুরু হয় চাকরি খোঁজার চেষ্টা। এদের মধ্যে কেউ কেউ পেয়েও যান কন্সট্রাকশনের চাকরি। যারা চাকরি লাভে ব্যর্থ হন তারা আবার ফিরে যান আগের বসবাসস্থলের দেশে। কিন্তু নিজেদের রেসিডেন্স পারমিট নবায়নের লক্ষ্যে আগের বসবাসস্থলে ফিরে যাওয়া এদের সবাইকে এক বছরের মধ্যে আবারও ফিরে আসতে হয় পর্তুগালে।
কারণ, এরই মধ্যে সরকার ঘোষণা করে যে, যারা পর্তুগালের রেসিডেন্স পারমিট পাবেন, তাদের কেউ পর্তুগাল ছাড়া অন্য কোনো দেশে গিয়ে কাজ করতে পারবেন না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদের সবাইকে পর্তুগালে থেকে যেতে হয়। কিন্তু কাজকর্ম না থাকায় ওই সময় সেই বাংলাদেশিদের বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়। কাজ নেই, থাকার জায়গা নেই। জোর করে গেস্ট হাউজগুলোতে থাকতে এদের বাধ্য করা হয়।
বাংলাদেশি এই অভিবাসীদের অধিকাংশই তখন লিজবন শহরের কেন্দ্রস্থল আজকের বাঙালি পাড়া মারটিম মনিজ, রসিও, কাইস ডু সদরে এবং আলকানটারায় থাকতে শুরু করেন। কেউ কেউ চলে যান খানিক দূরে কষ্টা কেপারিকাতে। বাংলাদেশি এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ তখন শুরু করেন মেট্রো ও এক্সপো কনস্ট্রাকশনের কাজ। অনেকেই চাকরির খোঁজে ছড়িয়ে পড়েন পর্তুগালের বিভিন্ন শহরে, শুরু করেন ফেরিওয়ালার কাজ। শহরের কেন্দ্রস্থলে কেউ কেউ বিক্রি করতে থাকেন ফুল, কেউ কেউ কাজ খুঁজে পান রেস্টুরেন্ট ও বারে।
পর্তুগাল বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রানা তসলিম উদ্দিনের দেওয়া হিসাব মতে, ১৯৯৬ সালে পর্তুগালে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা গিয়ে উঠে প্রায় ১৫শ’র কাছাকাছিতে। কিন্তু এদের অবস্থা থেকে যায় সেই আগের মতোই। নেই কাজ, নেই থাকার জায়গা। অপেক্ষাকৃত সেটেলড (প্রতিষ্ঠিত) বাংলাদেশিরা তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন নতুন অভিবাসীদের দিকে। তারা তাদের নিজেদের থাকার জায়গা শেয়ার করেন নতুনদের সঙ্গে, শুরু করেন সীমিত আকারে বিজনেস পার্টনারশিপ। থাকার জায়গা শেয়ার করতে গিয়ে তখন একটি রুমে ৭-৮ জন গাদাগাদি করে থেকে পুরাতনরা নতুনদের দেখিয়েছেন সহমর্মিতা। সেসময় এদের অনেকেই করেছেন ফেরিওয়ালা ব্যবসা। একটি গাড়িতে করে ৫ জন পর্তুগালের উত্তর থেকে দক্ষিণে ফেরি করে বেড়িয়েছেন তাদের অরিয়েন্টাল পণ্য।
এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার বায়তুল মোকাররম মসজিদ। নামাজ ছাড়াও এই মসজিদকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ধর্মীয় শিক্ষাদান কার্যক্রম। পাশাপাশি নিজেদের সংস্কৃতির প্রসারে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাও শুরু করেন।
২০০১ সালে পর্তুগালে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজারে। এদের অধিকাংশই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এখানে শুরু করেন বসবাস, পুরোনো অভিবাসীদের অনেকে দেশ থেকেও আনতে শুরু করেন নিজেদের স্ত্রী-সন্তান। এই সময় সরকার ঘোষণা করে যারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন, তারা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই সুযোগ সরকার ২০০৭ সাল পর্যন্ত বহাল রাখলে পর্তুগালে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ১২ হাজারে উন্নীত হয়। এই সময়ে কমিউনিটি আর একস্থানে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে। ওই সময় যার যার বসবাসস্থল এলাকা থেকেই রেসিডেন্স পারমিট লাভ করেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা। অনেকেই তখন শুরু করেন ক্ষুদ্র-ছোট ব্যবসা, মিনি মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, হ্যান্ডসক্রাফ্ট ও এশীয় পণ্যের হোলসেল বিজনেস।
এই সময়েই অভিবাসী কমিউনিটি ব্যাপক আকারে শুরু করে নিজেদের পরিবার নিয়ে আসা। অনেকেই তখন লিজবনে ক্রয় করেন নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট, শুরু করেন সন্তানদের স্কুল-প্রতিষ্ঠানে পাঠানো। এই সময়ের মধ্যেই প্রায় দু’শো বাংলাদেশি শিশু ভর্তি হয় পর্তুগালের মূলধারার স্কুলগুলোতে, বাংলাদেশিরা শুরু করেন পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষা। একই সময় সরকার ঘোষণা করে, যারা ৬ বছরের বেশি সময় ধরে পর্তুগালে বসবাস করছেন, ভাষা জানেন, অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার রেকর্ড নেই তারা পর্তুগালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই সুযোগ গ্রহণ করে ওই সময়ই ৫-৬ হাজার বাংলাদেশি আবেদন করে পর্তুগিজ নাগরিকত্ব লাভ করেন। এরপর দিনে দিনে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েছে পর্তুগালে। ২০১০ সালের হিসাব মতে, ৪ থেকে ৫শ পরিবারসহ পর্তুগালে তখন বাংলাদেশিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার।
২০০৯ সাল থেকে পর্তুগালের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে অন্যান্যের মত বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও এর ধাক্কা লাগে। অনেক বাংলাদেশিই তখন নিজেদের ব্যবসা হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পর্তুগাল ছাড়তে শুরু করেন। এদের কেউ কেউ ব্রিটেন, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এভাবে ৬-৭ হাজার বাংলাদেশি পর্তুগাল ছেড়ে যান।
বাংলাদেশিদের অনেকে ওই সময় পর্তুগাল ছেড়ে গেলেও ২০১৪ সালে ব্রিটেনের স্টুডেন্ট ভিসা মেয়াদ উত্তীর্ণ তরুণদের একটি বিরাট অংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হয়ে আবার পর্তুগালে এসে আশ্রয় নেন। এরাই এখন রয়েছেন রেসিডেন্স পারমিটের অপেক্ষায়, কেউ কেউ এরইমধ্যে পেয়েছেনও। এদের আগমনে কমিউনিটি হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। দেশটির পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রায় ৮০ শতাংশেরই বসবাস লিজবনে। বর্তমানে এখানে বাংলাদেশি মালিকানাধীন দোকান রয়েছে প্রায় ৬শ’। দেশীয় রাজনীতি চর্চাসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রসার প্রচারণাও করছে এখানকার কমিউনিটি।
গত বছর স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের দেওয়া জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী শহীদ মিনার ‘কাম্পো মারতির ডা পাতরিয়া’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মূলধারার অনেকেই এখানে এসে শ্রদ্ধা জানান বাঙালির ভাষা সৈনিকদের।
বাংলাদেম সময়: ০৫৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৬
এইচএ/