সান্দাকান (বোর্নিও) থেকে: মেঘের ভেতর ঢুকে গেলো বিশাল বপুর স্ক্যানিয়া বাসটা। দু’পাশের পাহাড় সারি হারিয়ে গেলো সাদা মেঘের পর্দার ওপাশে।
অলটিমিটারে রিডিং ঠেকেছে ৫ হাজার ৪৩৬ ফুটে। তার মানে সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার উপরে গড়াচ্ছে শক্তিশালী ইঞ্জিন আর ভারী চেসিসের স্ক্যানিয়ার চাকা। তাহলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের চেয়েও ২ হাজার ফুট বেশি উঁচু এ সড়ক! অথচ কেমন অনায়াসে মেঘ ফুঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে যাত্রীবাহী বাসটা!
এতো উঁচু রাস্তাতেও প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি, মালবাহী ট্রাক আর মোটর সাইকেল চলছে। এমনকি মাউন্টেন বাইকে পেডেল চেপেও পাহাড় পাড়ি দিচ্ছে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা।
যদিও সব গাড়িই চলছে ফগ লাইট জ্বালিয়ে। কিন্তু কখনোই কোনো গাড়িকে হর্ন দিতে শোনা গেলো না। বাংলাদেশ আর ভারতের পাহাড় বাওয়া গাড়িগুলোর সঙ্গে আর একটা বড় পার্থক্য ধরা পড়লো এখানকার আজদাহা গাড়িগুলোর। পাহাড়ে উঠলে এসি নাকি চালানো যায় না বাংলাদেশ-ভারতে। কিন্তু এখানকার যাত্রীবাহী স্ক্যানিয়াতে এসির ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার যোগাড়। তারওপর সামনের স্ক্রিন কাঁপাচ্ছে জ্যাকি চান।
১৩ হাজার ফুট উঁচু কিনাবালু পাহাড় ঘিরে গড়া ন্যাচারাল পার্কের গোড়া ছুঁয়ে এগিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর অবশ্য পাতলা হলো মেঘের দল। পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার আগে পাহাড়ের মাথায় উদয় হলো সূর্য। মেঘধোঁয়া ট্রান্স বোর্নিও এক্সপ্রেসওয়েতে তারই ঝিলিক।
সেই সারাওয়াকের কুচিং থেকে শুরু করে ব্রুনাই পেরিয়ে সাবাহর রাজধানী কোটা কিনাবালুতে ঢুকেছে ১২৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রাস্তা। তারপর কিনাবালু পাহাড়ের আকাশ ছোঁয়া পথ পেরিয়ে সান্দাকান হয়ে এগিয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়া সীমান্তের শহর সেমপরনার দিকে।
এখানকার পাহাড়ি পথের পাশে লোহার জালে পাথর ভরে বসানো হয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়। পাহাড় ধসের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি তাই। রাস্তাটাও এগিয়েছে পাহাড়ের পাশে ঝুলে। যেখানে জায়গা কম সেখানে পাহাড় না কেটে বরং গড়া হয়েছে কংক্রিটের সেতু। পাহাড়ি বন ছুঁয়ে এগিয়ে যাওয়া ইলেকট্রিক লাইন প্লাটিকের মোড়কে মোড়া। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি পাশ কাটাতে কতো না আয়োজন এখানে!
একটু পরই বোর্নিওর চায়ের জন্য খ্যাত রানাও এলাকা পাশ কাটালো স্ক্যানিয়া। পাহাড়ের শরীরে ঝুলে থাকা বৃক্ষলতার মধ্যে সেগুন গাছের সারি আবারো স্মৃতির পাতায় ফিরিয়ে আনলো বান্দরবানের পাহাড়গুলোকে। তবে এখানকার পাহাড়গুলোতে জুম চাষের চিহ্নও নেই। জনবসতির ঘনত্ব কম বলে পাহাড়ের শরীরগুলো এখনো যে অছোঁয়া রয়েছে তাও নয়। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে হিমালয়ের মতো ধাপ পদ্ধতির চাষাবাদ। এখানকার কলাগাছগুলো কিন্তু ছোটই বটে। বাঁশগুলোতে পাতা কম, আকাশ ছোঁয়া রেইন ট্রি’র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সটান উঠে গেছে আকাশ পানেই। বাংলাদেশের পাহাড়ি পথের পাশে দেখা ঝাড়ু ফুলের গাছ চোখে পড়লো এখানেও। রক্তজবা অবশ্য দেখা গেলো না, কিন্তু ছোট ছোট নীল আর গোলাপী ফুল নয়ন জুড়িয়ে দিলো।
যাত্রাবিরতিতে বাংলাদেশের হাইওয়ের পাশের রেস্তোরাঁগুলোর মতো গলাকাটা দাম হাঁকলো না। শহরের মতো এক রিঙ্গিতই থাকলো পানির দাম। টয়লেটেও নাড়ি উল্টানো দুর্গন্ধ নেই। রাস্তার পাশে রাখা ডাস্টবিনেই বোতল আর প্যাকেট ফেলছে সবাই।
কোটা কিনাবালু থেকে ঘণ্টা দেড়েক আসার পর শুরু হওয়া কিনাবালু পাহাড়ের সঙ্গ ত্যাগ করা শুরু হলো আরো ঘণ্টা দেড়েক পর। সমতল ভূমিতে নেমে এ যেনো আর এক বিস্ময়! দু’পাশে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পামবন। সেই পাম বনের ওপরে ঝুলে আছে গোধূলির আকাশ। স্ক্যানিয়াটা ছুটছে তো ছুটছেই। এ ছোটার বুঝি শেষ নেই। এক সময় তো মনে হলো, পাম বন ছাড়া আর কিছুই বুঝি নেই এদেশে।
আরো ঘণ্টা দেড়েক ছোটার পর শেষ হলো পাম বনের মেলা। এবার চোখে পড়ছে একটা দু’টা আলো জ্বলা বাড়ি। সামনে সাবাহ রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সান্দাকান।
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৬
জেডএম/এমজেএফ