ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

আমার দেখা জাপান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৭
আমার দেখা জাপান একযুগ ঘুরে বেড়ালেও জাপানের সব সৌন্দর্য দেখা শেষ হবে না

জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশে। তাও আবার জাপান। দেশটি সম্পর্কে আগে থেকে কিছু ধারণা ছিল। ধারণা আর কল্পনার চেয়েও বাস্তবে অনেক ফারাক। সেটি টোকিও’র হানেদা বিমানবন্দরে নেমেই টের পেলাম। একটি দেশের বিমানবন্দর এতো সুন্দর গোছানো হতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না। যাত্রী বা অপেক্ষমাণ মানুষের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে সেখানে।

যাইহোক এক মাসের দীর্ঘ ভ্রমণে অনেক কিছুই ঘুরে দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে এক যুগ ঘুরলেও জাপানের সব সৌন্দর্য দেখে শেষ করতে পারবো না।

তবে যা দেখেছি তা কখনো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। রাস্তা-ঘাট, পার্ক-বিনোদন কেন্দ্র, অফিস-আদালত, পাহাড়-পর্বত সবকিছুই সুন্দর সাজানো গোছানো।  

গ্রাম থেকে শহর কোথাও কোন রাস্তায় ময়লা আবর্জনা নেই। একটা কাগজের টুকরো পর্যন্ত নেই। জাপানের গ্রামগুলো বাংলাদেশের গ্রাম ভাবলে ভুল করবেন। জাপানে নাগরিক সুবিধা সব জায়গায় সমান। প্রযুক্তির কথা তো বলাই হয়নি। জাপানের মানুষ প্রতিটি কাজ কোন না কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে করেন। জাপানে ধানক্ষেত বা শস্যক্ষেতে যেতে যে রাস্তা ব্যবহার করে বাংলাদেশে সেরকম সুন্দর কোন মহাসড়কও নেই।
 
বৈচিত্র্যে ভরপুর জাপানের সবখানেই ছড়িয়ে আছে উঁচু পাহাড়-পর্বত। এসব পাহাড়-পর্বতকে ভেদ করে কিভাবে বিশাল বিশাল রাস্তা কত শত বছরে তৈরি করেছে আল্লাহ জানেন। প্রথম গন্তব্য টোকিও থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে ইয়ামানাসি প্রিফেকচার। যাওয়ার সময় কখনো মনে হয়েছে বিশাল পাহাড়ের নিচ দিয়ে আবার কখনো পাহাড় আর মেঘের গাঁ ঘেষে। আবার কখনো মাইলের পর মাইল পাহাড়ের বুক ভেদ করে বিশাল টানেল বা সুড়ঙ্গ দিয়ে। কি চমৎকার দৃশ্য।

এক মাসের ভ্রমণে নানা জায়গায় গিয়েছি। সঙ্গে ছিলেন আমার স্বামী।

ফেরার আগে একদিন টোকিও’র প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু আকিহাবারায় গেলাম। শুধু জাপান নয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট ‘আকিহাবারা’। প্রথমে পা বাড়িয়েই বুঝতে পারি কেন জাপানকে প্রযুক্তির তীর্থভূমি বলা হয়। দাঁত ব্রাশ করার টুথব্রাশ থেকে বিশাল আকারের থ্রিডি টিভি কী নেই সেখানে। সাত তলা এই বিশাল প্রযুক্তি সম্ভারে বিশ্বের প্রায় সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য পাওয়া যায়।

জাপানে সুনীল সাগরের কথা শুনেছি। বিচে গিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে একদিন টোকিওর অন্যতম আরেকটি পর্যটন স্থান ওদাইবাতে গিয়েছিলাম। টোকিও’র সাগরপাড়ে অবস্থিত এটি একটি কৃত্রিম দ্বীপ। যেখানে রয়েছে অনেকগুলো স্পট। টিভি স্টেশন, বেড়ানো, শপিং, আর্কিটেকচারাল সৌন্দর্য,  পার্ক, পাচঁতারকা হোটেলসহ জাপানিদের বিনোদন দেখার জন্য এটা চমৎকার জায়গা। কিন্তু বৃষ্টির কারণে তেমন ঘুরতে পারিনি।

একযুগ ঘুরে বেড়ালেও জাপানের সব সৌন্দর্য দেখা শেষ হবে না

জাপানে চারদিকেই সমুদ্রবেষ্টিত। ছোট বড় প্রায় তিন হাজার দ্বীপ রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে দেশটিকে সূর্য উদয়ের দেশ বলা হয়। এরপর কখনো জাপানে যাওয়ার সুযোগ পেলে অবশ্যই সবার আগে সমুদ্রের পাড়ে যাবো।  
  
জাপানিরা কাজ পাগল জাতি। সততা-সাহস, মেধা-যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে কাঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তুলেছে। অর্থ, বিত্ত, কাজ, আচরণ, প্রযুক্তি ইত্যাদি অনেক কিছুর জন্যই তারা বিশ্ব বিখ্যাত।
 
জাপানে রাস্তায় বের হলে দেখবেন কয়েন বক্স মেশিন। যেখানে কয়েন বা স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে মেশিনে পানি, চা, কফি, জুস, আইসক্রিম বা অন্যন্য ড্রিংকস কেনা যায়। প্রত্যেক এলাকায় প্রায় দু-চার মিনিট হাঁটলেই সুপার শপ দেখা যায়, যেখানে প্রয়োজনীয় সব কিছুই কিনতে পাওয়া যায়, সঙ্গে রয়েছে পাবলিক ফোনবুথ যা বিদেশিদের জন্য খুবই জরুরি। কারণ জাপানে বর্তমানে ১ বছরের কম ভিসা হলে বিদেশিরা মোবাইল সিম কিনতে পারে না এবং প্রত্যেককে সিম কিনতে হলে বৈধ নাগরিকত্বের সব কাগজপত্র জমা দিয়ে তারপর সিম কিনতে হয়। সিম ক্রয় করতে অবশ্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। অর্থাৎ ফোন কেনা সহজ কিন্তু সিম কেনা কঠিন।

জাপানে গেলে যে জিনিসটি বেশি চোখে পড়বে তা হল-ছোট বড় সবাই সাইকেল চালানো। বাচ্চা হাঁটতে পারলেই তাকে একটি সাইকেল কিনে দেওয়া হয়, সে বাবা মার পেছনে পেছনে সাইকেল চালিয়ে চলাফেরা করে। যারা এখনও হাঁটতে পারে না তারাও সাইকেলে চড়ে, তবে তা বাবা/মার সাইকেল ক্যারিয়ারে। তারা অনেকে শখ করে আবার অনেকে প্রয়োজনে সাইকেল চালায়। তারা তাদের প্রয়োজনকে একটি সুন্দর সিস্টেমে পরিণত করেছে। কারণ আমাদের মত রিকশা কনসেপ্ট তাদের নেই। গাড়ির জন্মভুমি জাপান। সবারই গাড়ি আছে। যার যার গাড়ি সেই চালায়। ড্রাইভারের সিস্টেম চালু নেই।

একযুগ ঘুরে বেড়ালেও জাপানের সব সৌন্দর্য দেখা শেষ হবে না  নিয়ম-কানুন এবং তা মানার জন্য জাপানিরা মনে হয় শ্রেষ্ঠ জাতি। গাড়ি বা সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে সব কাজেই রয়েছে সুন্দর নিয়ম কানুন এবং প্রায় সবাই তা যথাযতভাবে মেনে চলে। আমার ৩০ দিনের ঘোরাফেরায় আমি একবারও দেখিনি কেউ সিগনাল না মেনে রাস্তা পার হচ্ছে, গাড়ি চালাচ্ছে, ভুল লেনে সাইকেল/গাড়ি চালাচ্ছে বা হর্ন দিচ্ছে। গাড়ির দেশে হাজারো গাড়ি চলছে নিশব্দে। প্রতিটি শহরই শব্দহীন। কোন শব্দ দূষণ নেই, কোথাও কোন ময়লা নেই, কেউ কারও জিনিস ধরে না, কারও জায়গা কেউ দখল বা ব্যবহার করে না। যার যার চাকরি নিয়ে সে সে ব্যস্ত। কেউ কারোর দিকে তাকানোর সময়-সুযোগ পায় না!  

বাচ্চাদের খেলাধূলার জন্য প্রত্যেক এলাকার জনবসতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পার্ক আছে। একটু পরপর পার্ক দেখা যায়। পার্ক, স্টেশন সব পাবলিক প্লেসে সুন্দর পাবলিক টয়লেট, বসার বা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এবং এতো সুন্দর ব্যবস্থা আমাদের দেশের ফাইভ স্টার হোটেলেও নেই। বড় মার্কেট, বেড়ানোর জায়গা ছাড়া আপনি রাস্তায় অযথা মানুষ খুব কমই দেখবেন। আবাসিক এলাকাগুলোতে একঘণ্টা হাঁটলে বড়জোর ৪-৫ জন লোকের সঙ্গে দেখা হতে পারে। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক রাত দিন ২৪ ঘণ্টা হাঁটুন বা ঘুরে বেড়ান কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। এজন্যই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর টোকিও। আসলে জাপানে সব শহরই একই রকম।

ওদের সততা, আচরণ, সম্মানবোধ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর কাজের প্রতি কমিটমেন্টসহ সবকিছুতেই শেখার আছে অনেক কিছু। যার কাছেই কোন সহযোগিতা চেয়েছি সে ভাষা না বুঝলেও আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন সহযোগিতার জন্য। কিছু কিনুন বা না কিনুন দোকানে গেলে তাদের বিনয় প্রকাশের সীমা থাকে না। জাপানিরা শ্রেষ্ঠ বিনয়ী জাতি। বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের রক্তে মিশে আছে সততা, সময় জ্ঞান এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা।

জাপানিরা খুব সুশৃঙ্খল জাতি। সময় এবং শৃঙ্খলা সেখানে অভাবনীয়। মিনিট নয়, সেকেন্ড ধরে সবাই চলাফেরা করেন। সবকিছু গণিতের অঙ্কে হিসেব করা। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটছে পাগলের মতো, কিন্তু কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। প্রায় তিনকোটি মানুষের শহর টোকিওতে মিনিটে মিনিটে ট্রেন বা বাস গন্তব্যে যাচ্ছে। কোথাও কোন হৈ চৈ নেই। সেকেন্ড হিসেব করে চলছে সব। সবাই সচেষ্ট কিভাবে অন্যকে বিরক্ত না করে বা কষ্ট না দিয়ে চলা যায়। পথে কোন সমস্যা হলে পুলিশ বা অন্য কোন ব্যক্তির সহযোগিতা চাইলে তারা খুবই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। পথে কোন ছিনতাই বা চুরির কোন আশঙ্কা নেই। নিশ্চিন্তে আপনি ভ্রমণ করতে পারেন। আপনি ভুল করে কোথাও কিছু ফেলে গেলে সেটা ফেরত সম্ভাবনা ৯৯ ভাগ।  

প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও কেবল জনগণের সৃজনশীলতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় কিভাবে একটা সুন্দর প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা যায় সেটা যদি আপনি দেখতে চান তাহলে জাপান একটি অনন্য উদহারণ। ১৮টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজসহ সাগর আর পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাপান ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গপুরী। তাই সময় পেলে অবশ্যই কাছ থেকে দেখে আসবেন সূর্যোদয়ের দেশ জাপানকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৬২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৭
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।