ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

ব্রিটেনে বাঙালিদের ২০১১: সফলতা এবং দুঃসহ চিত্র

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১২
ব্রিটেনে বাঙালিদের ২০১১: সফলতা এবং দুঃসহ চিত্র

জীবনের চড়াই উৎরাই পেরুতে পেরুতে মানবতার ইতিহাসে প্রতিনিয়ত সংযোজিত হয় নুতন নুতন অধ্যায়। অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনায় আর সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতা হয় ভারি।

কোনো দুর্ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে, আবার অনেক ব্যাপারই আমাদের দিয়ে যায় এগিয়ে যাবার প্রেরণা। এই প্রেরণায় বিশ্বমানব প্রাণিত হয়, আমরা এগিয়ে যাই। সারা পৃথিবীর দেশে দেশে এভাবেই চলছে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়া। পৃথিবীর সাথে ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিও সংগ্রামে-সংঘাতে কিংবা মেধায়-মননে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সংগ্রাম। এখানে টিকে থাকতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে আগের মানুষগুলোর। সংগ্রামে হারিয়েছি আমরা অনেক কিছু। এরপরও আমাদের সাফল্যের চমৎকার উদাহরণ আছে।

ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে লাখ লাখ বাঙালির বলতে গেলে প্রধান আবাসস্থল লন্ডন। এই লন্ডনকে ঘিরেই বাঙালিদের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে বিশ্বময়। ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী উঠে এসেছেন আবার বিশ্ব মিডিয়ায়। ব্রিটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন স্টেটসম্যানের কভার স্টোরিতে রুশনারা আলীকে ২০ জন প্রভাবশালী এমপির একজন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এমনকি এ ২০ জনের মাঝে আগামীতে তারও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে আভাস দিয়েছে। একই ভাবে বহু আলোচিত ব্রিটেনে নির্বাচিত প্রথম বাঙালি নির্বাহী মেয়র হলেন লুৎফুর রহমান। টাওয়ার হ্যামলেটসে এই প্রথম সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ভোটে যেমন তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, ঠিক তেমনি ব্রিটেনের রাজনীতিতে ১০০ জন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের একজন হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পেরেছেন তার মেধাবলে । তা-ও ডেইলি টেলিগ্রাফের মতো পত্রিকার ‘টপ হান্ড্রেডস মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পিপলস অন দ্যা লেফট’ শিরোনামের খবরের একজন হয়ে। ব্রিটেনের বিভিন্ন কাউন্সিলের স্থানীয় নির্বাচনে বাঙালিদের হয়েছে আশাতীত উত্থান। লন্ডনের বিভিন্ন কাউন্সিলে লিডার, মেয়র, কেবিনেট মেম্বার হয়েছেন।

লন্ডনের বাইরে অনেক জায়গায় রুশনারা আলীর পথ ধরে বাঙালি নারীরা কাউন্সিলে প্রার্থী হয়েছেন। মোটামোটি দু-একটি ওয়ার্ড বাঙালি অধ্যুষিত হলেও ওল্ডহ্যাম এলাকা মূলত সাদাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সংসদীয় এলাকা। এই এলাকায় গত বছর ব্রিটেনের ১০০ বছরের ইতিহাসে এক দুঃখজনক ঘটনার জন্ম হয় সেখানকার নির্বাচিত এমপি লেবার পার্টির ফিল উলাসকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনের সময় তার কিছু প্রচারণাকে বিরোধীপক্ষ আদালত পর্যন্ত নিয়ে যায়, এবং আদালত একসময় তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে দেন। সেই শূন্য স্থানে লেবার পার্টির হয়ে লাইম লাইটে উঠে আসেন ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের সাবেক মেয়র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আব্দুল জব্বার। চারজন শর্টলিস্টধারীর মাঝে শেষ পর্যন্ত মাত্র একটি ভোটের ব্যবধানে তিনি পার্টির মনোনয়ন পাননি।

উল্লেখ্য, এই উপ-নির্বাচনে লেবার পার্টির মনোনীত প্রার্থী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। লন্ডনের বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা করেছে চমকপ্রদ ফলাফল। এমনকি লন্ডনের বাইরে নর্থওয়েস্ট ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের একজন বাঙালি ছাত্রী এবং আস্টন কাউন্সিলে একজন বাঙালি বংশোদ্ভূত ছাত্র পেয়েছে ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার।

২০১২-তে অনুষ্ঠিত হবে অলিম্পিক লন্ডনে। সেভাবেই সাজছে লন্ডন। লন্ডনকে সাজাতে গিয়ে ব্রিকলেন পেয়েছে কারি ক্যাপিটালের মর্যাদা।

উল্লেখ্য, ব্রিকলেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৯৫ শতাংশই বাঙালি ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত। এই অলিম্পিককে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে ছাড় হয়েছে পাঁচ পাউন্ডের স্মারক মুদ্রা। এই মুদ্রার ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন ব্রিটিশ-বাঙালি সায়মন মিয়া। বার্মিংহাম স্কুল অব আর্কিটেকচারের মাস্টার্সের ছাত্র সায়মনের মুদ্রা প্রকাশ করেছে রয়েল মিন্ট।

গত বছরে ব্রিটেনে দুটো উল্লেখযোগ্য দাঙ্গা হয়েছে। এর মাঝে একটি হলো ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি নিয়ে, অন্যটি বলতে গেলে ইস্যুহীন দাঙ্গা। ইস্যুহীন দাঙ্গায় শুধুই লুটপাট করেছে ব্রিটেনের তরুণ-তরুণীরা । ভাঙচুর করেছে। শত শত তরুণ-তরুণী এতে সাজা পেয়েছে। কিন্তু এ অপরাধে বাঙালিদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। এটা কমিউনিটিকে কিছুটা হলেও ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে।

আবার ওই লন্ডনের বাঙালিরাই দিয়েছে ব্রিটেনের অভিবাসীদের কিছু দুঃসহ চিত্র। গত বছরের প্রায় প্রতিটি সপ্তাহেই আমাদের পড়তে হয়েছে কোনো না কোনোভাবে দুঃখজনক ঘটনার কথা। কেবল বিয়োগান্তক ঘটনা নয়। লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটিয়েছে বাঙালীরা গত বছর বিভিন্ন সময়ে। তরুণদের একটি অংশ জড়িয়েছে ড্রাগসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতায়। ছেলের হাতে মা খুন, পিতা খুন হবার মতো ন্যক্কারজনক ঘটেছে গেলো বছর। ঘটেছে স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ। ইন্সুরেন্স জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্থ, এবং সেজন্যে যেতে হয়েছে জেলে। এ বছরেই একজন বাঙালি যুবকের সাজা ব্রিটেনের মিডিয়ায় ফলাও হয়েছে। ম্যানচেস্টারে পড়তে আসা রাজিব নামের এক বাংলাদেশিকে ৩০ বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান উড়িয়ে দেওয়ার তার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলে তাকে এই সাজা দেওয়া হয়। মিডিয়ায় ফোকাসের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা এ নিয়ে একটা অস্বস্তিতেই পড়ে গিয়েছিলো।

২০১০ সালেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অভিবাসীদের উঠতে হয় ব্রিটেনের আদালতের কাঠগড়ায়। গত বছরের ১০ জুলাই লন্ডন স্কুলস অব ইকোনমিকসে আয়োজন করা হয় মানবাধিকার বিষয়ক এক সেমিনার। বাংলাদেশ বিষয়ক এই সেমিনারে যোগ দিয়েছিলেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা এবং দুজন মন্ত্রী। একই সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সাবেক বিএনপি সরকারের আমলের একজন মন্ত্রীও। ওই দিন মঞ্চের চেয়ারে বসা নিয়ে দুই দলের মাঝে বিতর্ক সৃষ্ঠি হয়। যেহেতু সরকারি দল এখানে একটু সুযোগ বেশি পেয়েছিল, অন্যদিকে বিরোধী দল তার যোগ্য আসন পায়নি, সেহেতু কর্মী-সমর্থকরা তা যেন মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রথমে চিৎকার এবং পরবর্তীতে চেয়ার ছুড়োছুড়িতে মেতে উঠে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন লর্ডসভায় একমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যরোনেস পলা উদ্দিন। তারই উপস্থিতিতে এই সংঘর্ষ চলাকালে একসময় তিনিই পুলিশ ডাকেন।

সেই ঘটনার বিচারকার্য শেষ হয়েছে সম্প্রতি। বিচারে দুজনকে সাজা দিয়েছেন বিচারক। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং আরেকজন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সমর্থক। জেলদণ্ড না হলেও তাদের দুজনকেই কমিউনিটি ওয়ার্কের সাজা দিয়েছেন বিচারক।

এভাবেই সাফল্যকে সাথে নিয়ে আমরা পার করেছি ব্রিটেনের গেলো বছর। আবার ঐ কমিউনিটিরই কিছু কিছু নৃশংসতা সেই সফলতাকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। কতিপয় মানুষের অপতৎপরতার মাঝেও এই কমিউনিটির আগামী বছর হয়ে উঠবে আরও সম্ভাবনাময় এই আশাবাদ রাখে ব্রিটেনের সব শহরের বাঙালিরা।

ফারুক যোশীঃ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।