ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

মানবিক রাষ্ট্র গঠনে আসুক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

হুমায়ুন আহমেদ শ্রাবণ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
মানবিক রাষ্ট্র গঠনে আসুক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে জনপ্রিয় এবং মূলধারার রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সুশাসন, সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নতুন নেতৃত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্রকাঠামোতে এমন পরিবর্তন দরকার, যা মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশ উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয়।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে মানবিক রাষ্ট্র গঠনে আসুক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিরাষ্ট্র পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য শুধু নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়; নিরাপত্তার বিষয়টি যখন মাটি-পানি-বায়ু ও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, তখন একটি রাষ্ট্রের আদর্শ হতে হবে পরিবেশবান্ধব।

চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যে প্রজন্মের জন্য সম্ভব হয়েছে, তারা যেকোনো প্রজন্ম থেকে পরিবেশ নিয়ে বেশি সচেতন। এদের মধ্যে বড় একটি অংশ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ভোটার। এরা পুরনো গত্বাঁধা নির্বাচনী ইশতেহারের বদলে নতুন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ইশতেহার গ্রহণ করবে, যেখানে নতুন নেতৃত্বে প্রগতিশীল ভাবনা ও পরিবেশ রক্ষা গুরুত্ব পাবে এবং যেখানে মানুষের চাহিদার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা সমন্বিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে ষাট-সত্তরের দশকে আমেরিকার পরিবেশ আন্দোলন কিভাবে রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে উঠেছিল, সে বিষয়টি অনুপ্রেরণা হতে পারে।

আজও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক মাঠে পরিবেশ রক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সংকটাপন্ন হলেও পরিবেশ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের, রাষ্ট্রের পরিচালকদের নীতিগত অবস্থান দৃঢ় নয়। এ অবস্থায় বেশির ভাগ নদ-নদী, বনাঞ্চল, মাটিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংসের পথে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই দায়ী।

বাংলাদেশে ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ শব্দযুগল মন্ত্রে পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদের বিস্তার লাভের কারণে। এর জন্য সাময়িকভাবে দেশের বাহ্যিক উন্নয়ন দেখা গেলেও মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের উপকরণ হয়ে উঠেছে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি এবং বড় করপোরেট গ্রুপদের জন্য। এসব কম্পানি-গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রকাঠামোকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।

একটা সময় ছিল, তখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের কল্যাণ। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজি ও ক্ষমতার লড়াই।

নির্বাচন হয়ে উঠেছে বাণিজ্য। এ জন্য নির্বাচনের সময় দেখা যায় টাকার খেলা। ব্যবসার টাকা দিয়ে নির্বাচনের প্রচার চলে, ভোটারদের হাতে টাকার খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে নির্বাচিত হয়ে দুর্নীতি করে সেই অর্থ আবার জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে নিয়ে নেয়। তাই আগামী দিনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে জিডিপি বৃদ্ধি না দেখে অতিরিক্ত উৎপাদন ও ভোগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে সমাজে মূলধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। আগামীর পৃথিবীতে এখনকার মতো করে পুঁজিবাদের আধিপত্য খুব বেশিদিন টিকবে না। প্রকৃতি ও পরিবেশে সুস্থতা এলে সমাজেও অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরবে, ক্ষমতার অপব্যবহার কমে আসবে, ভোগের তাগিদ কমবে। কিন্তু এখানে বড় অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে বিপুল জনসংখ্যার সমস্যা। যারা ভোটার এবং যাদের কয়েক যুগ ধরে সুনাগরিক কিংবা সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়নি, রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোতে যাদের শুধু ভোটের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে গতানুগতিক নির্বাচনে নামে মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করা যায় গণতন্ত্রের সুফল জনগণকে দেওয়া ছাড়াই। এ জন্য অসচেতন জনগোষ্ঠী জানেও না রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই তারাও ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাদের মতো সাময়িক নিজের স্বার্থ নিয়েই শুধু ভাবে। এসবের জন্য নির্বাচনে বাড়াবাড়ি রকমের ক্ষমতার শোডাউন, উচ্চ শব্দে মাইকের ব্যবহার দেখা যায়, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে উচ্চ শব্দে মাইকের ব্যবহার শিশু ও বয়স্কদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নির্বাচনী প্রার্থীদের কাছে সাধারণ জনগণের এই কষ্ট-ভোগান্তি বিবেচ্য নয়। রাষ্ট্রের সবার সুবিধা নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে এর নৈতিক অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে হবে। নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংরক্ষিত আসন নারীদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রবেশাধিকার দিলেও পদ্ধতিগতভাবে প্রক্রিয়াটি ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে যেভাবে ব্যবহৃত হয়, তা নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে না। বড় রাজনৈতিক দলের উচিত নারীদের বেশি করে মনোনয়ন দেওয়া। রাষ্ট্রকাঠামো এমনভাবে গঠন করতে হবে, যেন একজন নারী কিংবা পুরুষ উভয়েই সুযোগ পায় এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। তাহলেই নারী-পুরুষের ক্ষমতার বৈষম্য কমবে এবং সমতা আসবে। সর্বোপরি ‘রিফর্ম বাংলাদেশ’ অর্থ শুধু ক্ষমতার পালাবদল না হোক। আসুক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ও মানবিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।

লেখক: স্নাতক, ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।