কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ট্রান্সকম গ্রুপকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমানের মাফিয়া গ্রুপ বলে অবহিত করেছেন। বুধবার (২৯ জানুয়ারি) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে অনেক তথ্য-প্রমাণসহ এ কথা বলেন তিনি।
একই পোস্টে সিমিন রহমানের ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর সঠিক বিচার দাবি করেছেন জুলকারনাইন সায়ের। আরশাদের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করে এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওই সময় সিমিন রহমানের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
সিমিন রহমানের ট্রান্সকম ২.০ বাংলাদেশ ২.০-এর মাফিয়া
একটা পরিস্থিতি কল্পনা করুন: এক সকালে আপনি খবর পান যে আপনার সুস্থ স্বাভাবিক ভাই, যিনি একা থাকতেন, কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। আপনি কী করবেন? প্রথমেই একটি অ্যাম্বুলেন্স ডাকবেন। যদি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়, তাহলে আপনি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবেন এবং মৃত্যুর কারণ জানতে চাইবেন। পোস্টমর্টেমের দাবি জানাবেন এবং নিশ্চিত হতে চাইবেন যে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেনি। দুঃখজনকভাবে, এসবের কিছুই ঘটেনি আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের ক্ষেত্রে, যিনি ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন।
২০২৩ সালের ১৬ জুন সকালে গুলশান ৩৬ নম্বর রোডের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে আরশাদ রহমানকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মৃত্যু ঘিরে অনেক রহস্য রয়েছে। মাত্র ১০ দিন আগে তিনি আইনি পরামর্শ নিয়েছিলেন, কারণ তিনি আদালতে তার মা এবং বোন সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন। কারণ, তারা প্রতারণার মাধ্যমে তার (আরশাদ) এবং তার অন্য বোন শাযরেহ হকের উত্তরাধিকার হরণ করেছেন।
বাবা লতিফুর রহমানের একমাত্র ছেলে হিসেবে তার সম্পত্তির বড় অংশ পাওয়ার কথা থাকলেও, একটি জাল ‘বণ্টননামা’ তৈরি করে তাকে সামান্য অংশ দেওয়া হয়, যা তার মা ও সিমিন তৈরি করেছিলেন ২০২০ সালে লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর।
বছরের পর বছর ধরে তার মা এবং সিমিনের সঙ্গে আরশাদের সম্পর্ক ছিল একেবারেই তিক্ত। যখন তারা জানতে পারেন যে, তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন, তখন ২০২৩ সালের ১১ তার মা উল্টো তার ও শাযরেজ হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর পাঁচ দিন পর, আরশাদ রহস্যজনকভাবে মারা যান।
প্রথমে ঘটনাস্থলে কারা উপস্থিত হয়? তার মা এবং সিমিন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ বোন শাযরেহ সেখানে ছিলেন না, যদিও এই বোনই ছিলেন তার সব জরুরি যোগাযোগের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি। আসলে শাযরেহ তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর অনেক পরে জানতে পারেন, সেটাও তার বাবার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মাধ্যমে।
যখন শাযরেহ ও তার স্বামী ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন পুরো ফ্ল্যাটটি ট্রান্সকম ও এসকেএফের কর্মচারীদের ভিড়ে ভর্তি। সেখানে তার মা, সিমিন এবং সিমিনের ছেলে উপস্থিত ছিলেন এবং তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
আরশাদের মরদেহ বিছানায় হাত-পা প্রসারিত অবস্থায় ছিল। তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, যা ইঙ্গিত করে সে অনেক আগেই মারা গেছে। তার আঙুল ও নখ কালচে হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। সিমিন নির্দেশ দেন, তাদের ছোট বোন শাজনীন তাসনিম রহমানের কবর খোঁড়া হোক, যাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আরশাদকে সেখানে দাফন করা যায়। ১৯৯৮ সালে শাজনীনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শাজনীনের মৃত্যুর পর লতিফুর রহমান বনানী কবরস্থানে নিজের পরিবারের জন্য ৮টি কবরস্থান কিনেছিলেন। তাই শাজনীনের কবর নতুন করে খোঁড়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুসনদ
কবরে দাফনের জন্য একটি মৃত্যুসনদ দরকার হয়। তাই মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এসকেএফের কর্মচারীরা পরিবারকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরাই সব ব্যবস্থা করতে চায়।
হাসপাতালের ডাক্তার জানান, মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাই পুলিশের রিপোর্ট দরকার। কিন্তু এসকেএফের কর্মচারীরা পুলিশের রিপোর্ট এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তাদের শুধু একটি কাগজ দরকার ছিল যাতে লেখা থাকবে, ‘আরশাদ মৃত’, আর কিছু না।
প্রদত্ত মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণ লেখা হয় ‘অজ্ঞাত (মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে)’, কিন্তু মৃত্যুর সময় উল্লেখ করা হয়নি। পোস্টমর্টেমের জন্য কোনো নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি, যা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য একটি দায়িত্ব পালন করেছিল। মৃতদেহ পরিবারকেই হস্তান্তর করা হয়, এসকেএফ কর্মীদের নয়। শাযরেহর স্বামী মরদেহের সঙ্গে ছিলেন, তাই তিনিই দেহটি গ্রহণ করেন। তবে সিমিন ‘নিজের প্রয়োজনের জন্য’ মৃত্যুসনদ চেয়ে নেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসকেএফের কর্মীদের অনুরোধে তা দিয়ে দেয়।
এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে কি?
এই কারণেই শাযরেহ তার ভাইয়ের মৃত্যুকে সন্দেহজনক বলে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (PBI) পাঠানো হয়, এবং তদন্ত দল এই ঘটনার গভীরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ট্রান্সকমের টাকা এবং ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টারের’ প্রভাব তদন্ত থামিয়ে দেয়।
পিবিআই রিপোর্টে বলা হয়, শাযরেহ নাকি নিজে থেকে আরশাদের মরদেহ উত্তোলন না করার অনুরোধ করেছেন—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আরশাদের চালক এবং ব্যক্তিগত রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, যদিও তারা সবচেয়ে বেশি তথ্য দিতে পারতেন। পরিবর্তে শুধুমাত্র একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সাক্ষাৎ নেওয়া হয়, যে দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য কাজ করতো। এমনকি তাদের দেওয়া বয়ানেও প্রচুর অসঙ্গতি ছিল।
আরশাদের মা-বোনের বাড়ির বাবুর্চির জবানবন্দী। জুলকারনাইন সায়েরের প্রশ্ন, তিনি (বাবুর্চি) তো ঘটনাস্থলে ছিলেন না! তবে তার বক্তব্য নেওয়া হলো কেন? আরশাদের নিজের বাবুর্চি ও ড্রাইভারের বক্তব্য নেওয়া হলো না কেন?
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, পিবিআই তদন্ত শেষ করে। কিন্তু এফআইআরের (FIR) ১১ জন আসামির কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেনি! এই অনিয়মের কারণে শাযরেহ এই বানোয়াট তদন্ত প্রতিবেদন বাতিলের দাবি তুলে নতুন করে সঠিক নিয়ম মেনে তদন্ত চান। কিন্তু এটা আদৌ হবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এমনকি ‘বাংলাদেশ ২.০’-এর যুগেও।
কেন? কারণ সরকারের অভ্যন্তরে এমন একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আছেন, যিনি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের মালিকদের—মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামদের বিশাল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যেখানে তাদের প্রভাব কম পড়ে, সেখানে আছে ট্রান্সকমের বিশাল সম্পদ—যা এখন পুরোপুরি সিমিন ও তার মায়ের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তাদের পক্ষে যেকোনো দরজা খোলা বা বন্ধ করা সহজ কাজ।
এটা যেন একেবারে ‘দাউদ বনাম গলিয়াথ’ পরিস্থিতি এবং আমরা চাই ন্যায়ের জয় হোক। শাযরেহ হক যেন তার ন্যায্য অধিকার পান—এক ইঞ্চি কম বা বেশি নয়।
আমি আপনাদের জন্য তিনটি অতিরিক্ত তথ্য দিচ্ছি
১. আরশাদের মৃত্যুর মাত্র চার দিন পর তার মা এবং সিমিন বোর্ড মিটিং শুরু করেন। তার মা নিজের ১০০টি শেয়ার ট্রান্সকম গ্রুপের সিএফও ও কোম্পানি সচিব কামরুল হাসানকে দেন, যাতে কামরুল আরশাদের বোর্ড আসনটি দখল করতে পারেন। অথচ কামরুল এফআইআরে উল্লেখিত মূল অভিযুক্তদের একজন।
২. আরশাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটটি এখনো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তার রাঁধুনি ও চালক এখন পুরোপুরি ট্রান্সকমের স্থায়ী কর্মী হয়ে গেছেন এবং তারা ওই ফ্ল্যাট ব্যবহার করছেন।
৩. আরশাদের মৃত্যুর ৪০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে সিমিন তার ছেলে যারাইফ আয়াত হোসনের জন্য এক বিশাল জমকালো বিয়ের আয়োজন করেন। এমনকি লোক দেখানোর জন্য হলেও তিনি নিজের ভাইয়ের জন্য ৪০ দিনের শোকের সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি, যা তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতি উদাসীনতারই প্রমাণ।
সৌজন্যে: নিউজটোয়েন্টিফোর