ঢাকা: বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও উত্তোরণের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সিনিয়র ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ। সিটি ব্যাংক এনএর বাংলাদেশের সাবেক সিইও এবং বিশ্বখ্যাত অডিট জায়ান্ট পিডব্লিউইসির সাবেক কান্ট্রি পার্টনার তিনি।
প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কীভাবে দেখছেন?
মামুন রশীদ: এখন আমরা বেশির ভাগ পে করছি অতীতের ভুলগুলোর জন্য।
আমি যেটা প্রথম মনে করি সেটা হলো—মুদ্রার বিনিময় হারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন। এটা অর্থনীতিকে আগে থেকেই ভুগিয়েছে। এরপর ছিল সুদের হারের নয়ছয়। এর সঙ্গে ছিল বড়দের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সহায়তা দেওয়া।
অথচ আমাদের অর্থনীতির প্রাণ এসএমই। তাদের অবহেলা করা হয়েছে। আমাদের জ্বালানি সমস্যা, পুঁজিবাজারের সমস্যা, তারল্যের সমস্যা। বেশির ভাগ ব্যাংক মালিকরা নিজেরাই ব্যাংকের টাকা নিয়ে গেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ইদানীং বেরোচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের ব্যক্তিগত মূর্খতার কারণে আমাদের শিল্পায়নের অর্থায়নে, আমাদের আর্থিক খাতকে এত বড় গচ্ছা দিতে হয়েছে। এখন আমরা মূলত অতীতের দেনা শোধ করছি।
আরেকটা বিষয় লক্ষ করছি, জুলাই বিপ্লবের পরে। আমি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দায়ী না করেই বলছি, আমরা আসলে পরিবর্তনের জন্য তৈরি না।
আমরা ১৬ বছর ধরে একটা মিউজিক গাইতে গাইতে একটা ছাঁচের মধ্যে, একটা বন্ধ্যত্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। যার ফলে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করছি যে আমরা আসলে অসক্ষম। আমরা নতুনত্বকে গ্রহণ করতে পারিনি, প্রযুক্তিকে এবং নতুনদেরও গ্রহণ করতে পারিনি। আমরা বিভিন্ন বোর্ডে বসি দেখছি খালি পুরনো ভূত এসে আমাদের ঘাড়ে ভর করছে। আমরা নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। অভিনব সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। প্রচণ্ড পারফরম্যান্স ওরিয়েন্টেড কালচার আনতে পারছি না। তরুণদের একটা সাইকেল ব্রেক করে প্রমোশন দিয়ে দেব, পারছি না। সামগ্রিকভাবে একটা সক্ষমতার অভাব দেখতে পাচ্ছি।
এখন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখছি, সময়ের ৭০-৮০ শতাংশ সময় চলে যায় ফাইল অনুমোদন করতেই। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছিলাম। আসলে মনেপ্রাণে আমরা ডিজিটাল করিনি। এর নামে তহবিল তছরুপ হয়েছে। শোনা যায়, ২০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবার এখন জেলে। আমাদের মন্ত্রীরা পালিয়ে গেছেন, অর্থমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন, বায়তুল মোকাররমের খতিব পালিয়ে গেছেন। সেই দেশের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে উই আর পেয়িং ফর দ্যাট।
এরপর আমরা আবার মাল্টিলেটারাল এজেন্সির মধ্যে ঢুকে গেলাম। তারা জানে না যে আমরা ভারত থেকে, শ্রীলঙ্কা থেকে আলাদা। আমাদের যন্ত্রপাতি আলাদা, এসব যে পরিবর্তন করতে হবে—এটা উনারা বুঝতে পারেন না। আমাদের রাজস্ব আদায় হয় না, সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। বিনিময় হার অদক্ষ, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অসক্ষমতা, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ, তারাও আবার বিরাট একটা সময় পার করতেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। সেই আলোকে আমরা অসক্ষমতার জন্ম দিয়েছি। মাল্টিলেটারাল এজেন্সির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা, রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, স্থানীয়ভাবে সম্পদের সঞ্চালনও করতে পারছি না আমরা। সে কারণে তাদের অন্যায্য শর্তও আমাদের মানতে হয়। এ কারণে আমাদের সুদের হার বাড়ানো, বিনিময় হারকে উদারীকরণ করতে হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কোনো গতি করতে পারছি না। অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছেন, না হয় জেলে আছেন। তাদের কারণে শ্রমিকরা সাফার করছেন, এখন মূল্যস্ফীতি এমন বেড়েছে—মধ্যবিত্তরাও সাফার করছে। প্রকৃত আয় কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে আমরা আসলে উত্তর পাচ্ছি না। আমরা যে মাল্টিলেটারাল এজেন্সির বাইরে গিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নেব সেটাও পারছি না।
প্রশ্ন : সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার এনবিআর উচ্চমূল্য স্ফীতির সময় ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। এ রকম সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?
মামুন রশীদ : আসলে এনবিআরের অনেক বিষয়ে বৈপরিত্য আছে। বাজেট আলোচনায় আমরা প্রস্তাবনা দিই এসবের কিছুই থাকে না। সংস্থার মেম্বাররা বলেন, পরবর্তীকালে তাদের অগ্রাধিকার চেঞ্জ হয়ে যায় রাজনৈতিক বাস্তবতায়। কিছুটা চেঞ্জ হয় ট্যাক্স জিডিপি হারের কারণে। তারা বলেন ‘বেগার্স ক্যান নট বি চুজার্স’। তখন আমরা ব্যাক টু দ্য বেসিক হয়ে যাই। ব্যাক টু দ্য বেসিক কী? সেটা হলো—আমরা আয়কর বাড়াতে পারি না। আমরা অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর মাফ করে দিই রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। ইদানিং বেশি হারে ব্যবসায়ীরা এমপি হচ্ছেন, তাদের স্বার্থ দেখতে হয়। আরেকটা বিষয় তারা বলেন, তা হলো—আয়কর আদায় কঠিন। এ জন্য ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সে চলে যাই। এটা সহজ। আসলে আমাদের ডাইরেক্ট ট্যাক্সে যাওয়া উচিত। ওদিকে জোর দেওয়া উচিত। সাধারণভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তবে ইদানীং জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এটাকে সমর্থন করি না। সময়টা অনুকূলে নয়। তবে অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআর চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত পানির দাম, দুধের দাম, রেস্টুরেন্টে খাওয়া—এগুলো বিবেচনা করেছেন, এটা ভালো দিক।
প্রশ্ন : কিছু মালিকের অনিয়মের অভিযোগে শিল্প বন্ধ করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন শিল্প বন্ধ না করে তা চালু রাখলে অর্থনীতির জন্য ভালো। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মামুন রশীদ : এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আপনি জেনে খুশি হবেন যে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের সমন্বয়ে একটা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পঁচাজন সম্মানিত উপদেষ্টার সমন্বয় পরিষদ। তাদের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি পরামর্শ হচ্ছে—শ্রমিকরা যেন চাকরি না হারান এবং শিল্প-কলকারখানা যেন চলতে পারে। আমি প্রথম ধাপে বলতে চাই, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, এখন এই শিল্পকারখানা চালাবে কে? আমাদের তো আইন নেই। ভারত একটি আইন করেছে ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংক্রাপসি কোড। যার ফলে ব্যাংকগুলোকে অধিকার দেওয়া হয়েছে তোমাদের যারা দুষ্ট ঋণগ্রহীতা, তোমরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করতে পারো। তখন ব্যাংকগুলো সেখানে নতুন পরিচালক দিতে পারে। এটাকে বলে ব্যাংক লেড সলিউশন। অথবা আমরা একটি হিসাব প্রতিষ্ঠানকে আনব, তারাই চালাবে। এটাকে লাভজনক করে হয় আগের মালিককে দিয়ে দেবে, অথবা নতুন মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেবে। এই আইনটা আমাদের নেই। এটা নিয়ে অনেকদিন ধরে বলেছি।
প্রশ্ন : শ্রমিকরা বলছেন তারা চালাবেন। এটা কি সম্ভব?
মামুন রশীদ : সম্ভব। তবে এর জন্যও ব্যাংক লেড মডেল লাগবে। আমরা এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আলাপ করেছি, যেকোনো বন্ধ কলকারখানা যারা নাকি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে, তারা যদি খুলতে চায় বা চালাতে চায়; সে ক্ষেত্রে ব্যাংক ‘মাস্ট টেক দ্য ড্রাইভিং রুল’। সে ক্ষেত্রে গর্তের গভীরতা কতটুকু তা বোঝার জন্য হিসাব অডিট প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে অবশ্যই আমাদের শিল্পকারখানা চালিয়ে যাওয়া উচিত। অবশ্যই যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কারখানাটি চালাবে কে? শ্রমিকরা আশা করছেন। কিন্তু কারখানা চালানোর জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন সেটা তো তাদের নেই। শ্রমিকের বেতন দেওয়া, পণ্য রপ্তানি করাসহ সব কিছু করে লাভও করতে হবে। এটা করার মতো লোকই তো নেই।
প্রশ্ন : বিনিয়োগ থমকে থাকায় ব্যবসায়ীরা সুদের হার কমানোর দাবি করেছেন। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করতে পারে?
মামুন রশীদ : আমি সুদের হার বাড়ানোর পক্ষে নই। আমি বলব এখন একটাই কথা—বিনিয়োগ, বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে বিনিয়োগের ওপর। আমাদের এখানে সাপ্লাই চেইনে ত্রুটি রয়েছে। কেন সুদের হার বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি কমছে না? সুদের হার বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। আমাদের প্রতিযোগী দুটি দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। শ্রীলঙ্কা সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে এখন মাইনাসে নামিয়ে এনেছে। এরা কীভাবে পারল? সুতরাং বিনিয়োগকে যেকোনো মূল্যে উৎসাহিত করতে হবে।
প্রশ্ন : বিনিয়োগের জন্য কী উপযুক্ত পরিবেশ আছে? উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভীতি ও আস্থাহীনতা কাজ করছে।
মামুন রশীদ : প্রথম কথা শিল্পপতিদের আস্থায় নিতে হবে। বিশেষ করে তাদের কারখানায় কোনো ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশকে অ্যাকটিভ করতে হবে। ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে অ্যাকটিভ করতে হবে। যেকোনো লোক এসে, ছাত্র-ছাত্রীরা এসে মহাখালীতে রাস্তা দখল করে ফেলল। কেউ এসে আমাদের লাইফ লাইন রাস্তা বন্ধ করে দিল—এয়ারপোর্টে কেউ যেতে পারছে না। দিস মাস্ট স্টপ। টেক ইট অর লিভ ইট। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রাইওরিটি দিতে হবে। সত্যিকারের যারা উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী, যাঁরা সমস্যায় পড়ে গেছেন, যাদের ব্যাংক ব্যাকআপ করতে রাজি আছে, সব নিয়মনীতি মেনে যদি মনে করা হয়, কিছু টাকা পেলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভাবছি তাদের কীভাবে সহায়তা করা যায়। আমি সরকারের তিনটি বোর্ডে কিংবা কমিটিতে কাজ করছি। আমি বলতে পারি, আমরা অলমোস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ৫০ কোটি টাকার ওপরে ঋণগুলোকে রিভিউ করা যায় কি না।
প্রশ্ন : একটা সময় ব্যাংকিং খাতে দুঃশাসন ছিল। এখন সুদের উচ্চ হার রয়েছে। আমরা বলছি বিনিয়োগ হচ্ছে না। রপ্তানিতে অনেক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো নিরাপত্তাহীনতায়। এ অবস্থায় কী পলিসি নেওয়া উচিত?
মামুন রশীদ : আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টাকা। এটা হয় কর আদায় করে, না হয় রপ্তানি বাড়িয়ে অথবা প্রবাস আয় থেকে নিতে হয়। কারণ, আমাদের ডলার দরকার। আমাদের যদি ডলার থাকে, স্পট মার্কেট থেকে তেল কিনতে পারি। গম কিনতে পারি। সুতরাং আমার দরকার টাকা। আর টাকার জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আমাদের প্রবাস আয় বাড়ছে। রপ্তানিও বাড়ছে। আমাদের সুশাসন বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিঅন্ড দ্য বক্স চিন্তা করতে হবে। আগের মতো ফোন করে ধমক দেওয়া চলবে না। অভিনব চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি সবাই মিলে বিতর্কের জন্ম না দিয়ে সততার আশ্রয় নিয়ে সুশাসনের মাধ্যমে, স্বজনপ্রীতি না করে দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টির লালন করতে পারি, তাহলে সব সম্ভব। আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। আমরা যেন দুর্নীতি না করি, গরিব মানুষের আহার নিয়ে অনিয়মে না জড়াই। তাহলেই হবে। আমি অবশ্যই আশাবাদী।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৫
এসআইএস