চাঁপাইনবাবগঞ্জ: আমের রাজধানী বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জকেই বোঝায়। শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এক মাস আগেই গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে।
আম চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর দেরিতে শীত আসায় এবং তাপমাত্রা বেশি থাকায় এক মাস আগেই আমের মুকুল আসতে শুরু করেছে। তবে গত বছরের মত আকস্মিক শৈত্যপ্রবাহ দিনব্যাপী ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টি নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় থাকলেও কৃষিবিভাগের দাবি গত বছরের মত শীতে বিরূপ আবহাওয়া বা বৃষ্টি না হলে এ আবহাওয়া আমের জন্য ক্ষতির কারণ নয়, বরং আর্শিবাদ।
পাশাপাশি এ বছর আমের জন্য অনইয়ার হওয়ায় আমের মুকুলের পরিমাণও বাড়বে। তবে আম চাষিদের একটি অংশ জানায়, মুকুল বের হওয়া শুরু করলেও পূর্ণাঙ্গ মুকুল ফুলে রূপান্তর হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় তেমন একটা আমের ক্ষতি হবে না।
জেলার বিভিন্ন বাগানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সারের উচ্চ মূল্য সত্বেও চাষিরা মাস তিনেক আগেই গাছে সার দেওয়া ও গাছের চারপাশের মাটি আলগা করার মাধ্যমে প্রথম দফা বাগানগুলো পরিচর্যা করেছে। এ বছর যেসব বাগানে অগ্রিম মুকুল এসেছে সেগুলোতে চাষিরা বালাইনাশক একদফা স্প্রে করেছে। তবে এ বছর পরিচর্যা খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাওয়ায় আমের নায্য মূল্য না পেলে লোকসানে পড়তে হবে চাষিদের।
আম চাষিদের অভিযোগ, এ বছর প্রতিটি সার ৫০ কেজিতে ১শ টাকা, শ্রমিকদের মজুরি গড়ে ১শ টাকা, সেচ খরচ গড়ে ২শ টাকা করে বেড়ে গেছে। কিন্তু সারা দেশেই আমের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় আমের দাম না পেয়ে লোকসানে পড়ছেন চাষিরা। চাষিদের দাবি গত বছরের মতো আমের দাম পেলে এ বছর অন্তত লোকসানের হাত থেকে বাঁচবে আম চাষিরা।
চাষিরা জানায়, আমের মুকুল দেখা দিলে সালফার ৫৫ ইসি এবং মুকুল ফুটে ফুলে রূপান্তর হলে মেনকোজেন বালাইনাশ দেওয়া লাগে। কিন্তু বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সালফারের দাম প্রতি ৩শ গ্রাম প্যাকেটে ১৫০ থেকে বেড়ে ১৭০, ৫৫ মি.লি বোতলের ৫৫ ইসি ৪৫০ থেকে বেড়ে ৫৫০, এবং মেনকোজেনের দাম ৫শ টাকা থেকে বেড়ে ৫শ ৮০ টাকা হয়েছে।
অন্যদিকে ৫০ কেজি বস্তার ডিএপি সারের দাম ৮শ থেকে বেড়ে ৯শ টাকা ও পটাশ সারের দাম বস্তায় ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এদিকে এক বিঘার একটি বাগানে একবার বালাইনাশক দেওয়ার জন্য শ্রমিক ও মেশিন ভাড়া ১৭শ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫শ টাকায় হয়েছে। আম গাছে সার দেওয়ার পর ঘণ্টায় সেচ খরচ ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শিবগঞ্জের চককীত্তি এলাকার আম চাষি ইউসুফ আলী জানান, তিনি গত বছর নিরাপদ আম উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের বাজারগুলিতে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তবে গত বছর তুলনামূলক আমের দাম বেশি থাকায় লোকসানের হাত থেকে বেঁচে যান। এর আগে গত ৩ বছরে আমের দাম না থাকা ও করোনাকালে আমের চাহিদা না থাকায় ৫০ লাখ টাকার লোকসান গুনেন।
অন্যদিকে শিবগঞ্জের পিঠালীতলা গ্রামের আম চাষি মনিরুল ইসলাম জানান, আম বাগান থাকলে তো পরিচর্যা করতেই হবে। লোকসানের কারণে এমনিতেই সংসার চলা দায়, তার ওপরে পরিচর্যা খরচ বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যাওয়ায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘা এর মত অবস্থা।
অপর আমচাষি তরিকুল জানান, প্রতি বছরের মতো গত বছর ফ্রুট ব্যাগিং আম উৎপাদন করেও বিদেশে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমের চাহিদা কমে যাওয়ায় আম বাগানগুলো এখন গলার কাঁটা। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানির সুযোগ বাড়লে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের চাহিদা বাড়বে। চাষি বাঁচবে। চাষি বাঁচলে জেলার অর্থনীতি মজবুত হবে।
সদর উপজেলার চাষি আতিক জানান, পুরাতন পদ্ধতি ও অধিক কীটনাশকের ব্যবহার ছেড়ে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে আম বাগানগুলো পরিচর্যা করতে হবে। সেইসঙ্গে সরকার কৃষকদের যেভাবে ভর্তুকি দিচ্ছে, আম চাষিদেরও প্রণোদনা বা ভর্তুকি দিলে জেলার আম শিল্প রক্ষা পাবে। নয়ত জেলার এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী লাক্ষা ও রেশমের মতই আমের অবস্থা হবে।
জেলা কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক জানান, জেলার চাষিরা আমের দাম না পেয়ে যেভাবে আমগাছ কেটে ফেলছে তা বন্ধ করতে হবে। জি আই পণ্য ক্ষিরসাপাত ও ফজলি আম গাছ না থাকলে জি আই সনদ নিয়ে লাভ হবে না। তাই জি আই পণ্যের কদর বোঝানোর পাশাপাশি চাষিদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। আম রপ্তানির জন্য দেশে কোনো কার্গো বিমান না থাকায় বিদেশে আমের দামের প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে না পেরে বাজার হারাচ্ছি। এতে করে আম রপ্তানি গত বছর মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশে আম রপ্তানি বাড়লে এবং আম কেন্দ্রিক শিল্প কারখানা হলে জেলার আমের চাহিদা বাড়বে। কৃষক আমের দাম পাবে। এজন্য সম্মানিত উদ্যোগ জরুরি।
শিবগঞ্জের আমচাষি আহসান হাবিব জানান, গত ২০২১ সালে বালাইনাশকের ব্যবহার কমাতে এবং নিরাপদ আম উৎপাদনের জন্য চীন থেকে পর্যাপ্ত ফ্রুট ব্যাগ আসায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি আমে ব্যাগ পড়ানো হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর দেড় থেকে ২ কোটি আমে ব্যাগিং করা হয়। গত বছর আম রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলেও এ বছর বিদেশে আম রপ্তানির ব্যাপারে আশাবাদী।
তিনি আরও জানান, এ বছর ইতোমধ্যেই জার্মানি ও রোম বাংলাদেশের নিরাপদ আম নেওয়ার আশা প্রকাশ করেছে। এই ২ দেশের আমদানিকারকরা বিমানবন্দরে নিরাপদ আম পৌঁছে দিলে তারা আম কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। আর বিদেশে আম রপ্তানি হলে চাষিরা আমের দাম পাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. পলাশ সরকার কৃষিপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে আম চাষ করলে বালাইনাশকের ব্যবহার কিছুটা কমানো যাবে। এতে কৃষকদের আমের পরিচর্যা খরচ কিছুটা সাশ্রয় হবে।
চলতি শৈত্যপ্রবাহে আমের ক্ষতি না হয়ে আরও উপকার হবে জানিয়ে বলেন, ঘন কুয়াশার পর সূয্যের আলো বের হলে মুকুলের কোনো ক্ষতি হবে না। তাছাড়া এ বছর শীত দেরিতে আশায় এবারের তাপমাত্রাটা আমের জন্য অনুকূল ও এ বছর অনইয়ার হওয়ায় আমের উৎপাদনও বেশি হবে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর অসময়ে কোনো দুর্যোগ না এলে আগাম মুকুলের কারণে আমের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কম। তাই উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে সব মিলিয়ে আম চাষিরা এ বছর আমের ন্যায্য দাম পাবে। গত বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৬ মেট্রিক টন। তবে এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ও উৎপাদন আরও বাড়বে।
প্রসঙ্গত, এ জেলার ৫ উপজেলায় ৩৭ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে ফলনশীল আম গাছ রয়েছে ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৮৯০টি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৩
আরএ